মেহেরপুর জেলার পরিচিতি

0
1604

মেহেরপুর জেলা (meherpur) বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের খুলনা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল।মুক্তিযুদ্ধের সময় মেহেরপুরে পাকিস্তান বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সংঘটিত বেশ কিছু প্রাথমিক যুদ্ধের সাক্ষী। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সর্বপ্রথম কমান্ড, দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ড গঠিত হয়েছিল পাশের চুয়াডাঙ্গা মহকুমা শহরে । ৪নং ইপিআর প্রধান মেজর আবু ওসমান চৌধুরী এবং ডাঃ আসহাব-উল-হক জোয়ার্দ্দার একই দিন সকাল ৯:৩০ এ চুয়াডাঙ্গা শহরের বড় বাজার চৌরাস্তার মোড়ে সর্বপ্রথম দখলদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। যার পরিপেক্ষিতে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর অঞ্চল প্রথম স্বাধীন বাংলার মুক্ত অঞ্চল হিসেবে আন্তপ্রকাশ ঘটে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর (meherpur) মহকুমার বোদ্দনাথতলায় আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করে অস্থায়ী সরকার গঠন করে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করে । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর মধ্যে মেহেরপুরে সম্মুখ যুদ্ধের কথা নথিভুক্ত আছে। ।২৬শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৪ সালে কুষ্টিয়া থেকে পৃথক করে মেহেরপুরকে স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা দেয়া হয়।

মেহেরপুর জেলার নামকরণ (meherpur)

মেহেরপুর (meherpur) নামকরণ সম্পর্কে এ পর্যন্ত দুটি অনুমানসিদ্ধ তথ্য আমরা জানা যায়। একটি হচ্ছে ইসলাম প্রচারক দরবেশ মেহের আলী নামীয় জনৈক ব্যক্তির নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ষোড়শ শতকের অথরা তার কিছুকাল পরে মেহেরপুর (meherpur) নামকরণের সৃষ্টি হয়েছে।

এ অঞ্চলে মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হতেই ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু হয়েছিল। বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বারোবাজার, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর সহ প্রভৃতি অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু করেন হযরত খাঁন জাহান আলী (রাঃ)। পীর খান জাহান আলী গৌড় থেকে ভৈরব নদী পথে মেহেরপুর হয়ে বারোবাজার গিয়ে বাগেরহাট গিয়েছিলেন। তার সাথে সেই সময়ে ৩৬০ জন দরবেশ ও ৬০ হাজার সৈন্য ছিল বলে কথিত আছে। তিনি সমগ্র দক্ষিণাঞ্চরে ইসলামের বিজয় পতাকা উত্তোলন করে জনবসতি ও শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেন। এ অঞ্চলে ঐ একই সময়েই বেশ কয়েকজন ইসলামের ঝান্ডাবাহক আল্লাহর পরম আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটে। শাহ ভালাই, শাহ আলাই ও এনায়েত উল্লাহর নাম উল্লেখযোগ্য। পুণ্য আত্না ইসলামের ঝান্ডাবাহক দরবেশ মেহের আলী শাহ-এর নামের সাথে সঙ্গতি রেখে মেহেরপুর নামকরণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।যতদূর জানা যায় তাতে মেহের আলী অত্যন্ত প্রভাবশালী খ্যাতিমান আধ্যাত্নিক ব্যক্তি হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন। যার ফলে তাঁর নামের প্রাধান্য পেয়ে যায়।

মেহেরপুর (meherpur) নামকরণের উৎপত্তি সম্পর্কে দ্বিতীয় দিকটি এখানে উল্লেখ্য, পূর্ববঙ্গ রেলওয়ের বাংলায় ভ্রমণ গ্রন্থে বিখ্যাত বচনকার মিহির ও তাঁর নিজের পুত্রবধু খনা (খনার বচন বিখ্যাত) ভৈরব নদীর তীরস্থ এ অঞ্চলে বাস করতেন। তার নামানুসারে প্রথমে মিহিরপুর এবং পরবর্তীতে অপভ্রংশে মেহেরপুর নামকরণ হয়েছে বলে অনুমান করা হয়।

মেহেরপুর জেলার পটভূমি

ইতিহাসের স্বর্ণপাতা থেকে অনেক অনেক পূর্বেই হারিয়ে গেছে মেহেরপুর-এর নামকরণ সম্পর্কে যথার্থ তথ্যসমূহ। অনুমান, অনুধাবন অথবা বিশ্লেষণ এই নিয়েই এ বিষয়ে আত্নতৃপ্তি ছাড়া গত্যন্তর নেই । দীর্ঘকাল ধরে এ বিষয়ে ব্যাপক লেখালেখি হয়েছে তবুও বিষয়টি তমাশাচ্ছন্ন রয়ে গেছে।

মেহেররপুর (meherpur) নামকরণ সম্পর্কে এ পযর্ন্ত দুটি অনুমানসিদ্ধ তথ্য পাওয়া গেছে। একটি হচ্ছে ইসলাম প্রচারক দরবেশ মেহের আলী নামীয় জনৈক ব্যক্তির নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ষোড়শ শতকের অথবা তার কিছুকাল ধরে মেহেরপুর নামকরণের সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয়ত বচনকার মিহির ও তার পুত্রবধূ খনা এই শহরে বাস করতেন বলে প্রচলিত আছে। মিহিরের নাম থেকে মিহিরপুর পরবর্তীতে তা অপভ্রংশ হয়ে মেহেরপুর নামের উৎপত্তি হয়েছে।

খ্রিস্টীয় ২য় শতাব্দীতে স্বনামধন্য ও খ্যাতিমান ভৌগালিক মিঃ টলেমির মানচিত্র গঙ্গা নদীর অববাহিকায় বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপ পরিলক্ষিত হয়। এই ক্ষুদ্র দ্বীপাঞ্চলকে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর (meherpur) অঞ্চল বলে মনে করা হয়। গঙ্গা অথবা বৃহত্তম কোন জলাময় স্থানের বুকে তিল তিল করে জেগে উঠা এক উর্বর দ্বীপাঞ্চলে দক্ষিণ বঙ্গ থেকে পুন্ডা বা পোদ জাতি অথবা পার্শ্ববর্তী স্থান থেকে বিভিন্ন ধর্মের বর্ণের জাতির কিছু কিছু লোক চাষাবাদ অথবা প্রচুর মাছ সংগ্রহের আশায় এ অঞ্চলে আগমন করে বসতি স্থাপন করেছিলেন বলে অনুমান করা যেতে পারে।

২য় শতাব্দীর শেষ পযর্ন্ত এবং ৪র্থ শতাব্দীর প্রথমার্থে পূর্ব বাংলার সমতট ও পশ্চিম বাংলায় পুস্কারণ রাজ্য অথবা পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্ত শাসনামলে এ অঞ্চলের কোন উল্লেখযোগ্য ইতিহাস সম্পর্কে শত চেষ্টা করেও কিছুই জানা যায়নি। বাংলাদেশে সমতট, বঙ্গ ও গৌড় এই তিন রাজ্যের শাসনামলে মেহেরপুর অঞ্চল কোন সময়ে সমতট আবার কখনো গৌড়ের শাসনাধীন ছিল। তবে এই তিনটি রাজ্যের সঠিক পরিধি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকগণ একমত হতে পারেননি বলে যদ্দুর জানা যায়। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দী পযর্ন্ত মেহেরপুর কোন রাজার প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে ছিল তা সঠিকভাবে জানা যায় না। ৬০৬ সালে রাজা শশাঙ্কর রাজত্বকালে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং বাংলাদেশে ভ্রমণ করে যে বিবরণ দিয়ে গেছেন তা থেকে বিশেষভাবে অবহিত হওয়া যায় যে তৎকালীন বঙ্গ রাজ্য (১) কামরূপ (২) পুষ্পবর্দ্ধন (৩) কর্ণ সুবর্ণ (৪) সমতট ও (৫) তাম্র লিপি এই পাঁচ ভাগে বিভক্ত ছিল। মেহেরপুর অঞ্চল সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাঙ্কর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে অনুমান করা হয়।

এছাড়া অনুমান করার যথেষ্ট যুক্তি আছে যে, শশাঙ্ক রাজ্যের রাজধানীর ৭০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত মেহেরপুর জনপদ তার প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে ছিল। শশাঙ্কের মৃত্যের পর গৌড় রাজ্য আভ্যন্তরীণ কলহে ও বিবাদে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। রাজা শশাঙ্কের মৃত্যের পর সম্ভবত ৬৪২ সালের দিকে মেহেরপুর কামরূপ রাজ ভাস্কর বর্মার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। শশাঙ্কের মৃত্যুর প্রায় একশত বছরকাল যাবৎ বাংলায় চরম অরাজকতা বিদ্যমান ছিল। সেই সময় কোন রাজাধিরাজ কোন অঞ্চলে তাঁদের শাসনভার বজায় রেখেছিলেন তা আজও পুরোপুরি অমানিশায় আবৃত। অস্টম শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার সময় অনুমান করা হয় মেহেরপুর পাল রাজত্বের শাসনাধীন ছিল এবং পাল রাজত্বের অবসান কাল অর্থাৎ দশম শতাব্দীর শেষ পযর্ন্ত এ অঞ্চল পাল রাজ্যভুক্ত ছিল।

লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে ১২০৩ মতান্তরে ১২০৪ সালে বিহার থেকে ঝাড়খন্ডের পথে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী নামক একজন তুর্কী মুসলিম অসীম সাহসী সেনাপতি মাত্র ১৮জন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে লক্ষণ সেনের রাজধানী নদীয়া দখল করেছিলেন। বখতিয়ারের পিছনে যে বিরাট সেনাবাহিনী ছিল তাদের মধ্যে মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী তার সঙ্গে দ্রুত আসতে সক্ষম হয়। অবশ্য বখতিয়ারের নদীয়া দখলের চল্লিশ বছর পর মিনহাজ-উস-সিরাজ রচিত ’’তবাকাত-ই-নাসিরী’’ গ্রন্থে উল্লেখ্ করা আছে যে, মাত্র আঠার জন অশ্বারোহী সৈন্য নদীয়া নগরীতে প্রবেশ করলে তাঁদেরকে তুর্কী অশ্ববিক্রেতা মনে করে কেহ বাধাদান করেনি। প্রকৃতপক্ষে সেই সময় লক্ষণ সেন বার্ধক্যজনিত কারণে রাজকার্যে অবহেলা, অমাত্যবর্গ ও রাজমহিষীর নানা ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতিতে সম্ভবত রাস্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল করে ফেলে। যার দরুন তুর্কী আক্রমণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ও সাহস লক্ষণ সেনের ছিল না।

খিলজী রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়েই আক্রমণ করেন। যে সময় ’রায় লছমণিয়া সকল কার্যাদি সমাপনে খাদ্য ভক্ষণে বসেছিলেন। তিনি যখন মুসলমান আক্রমণের সংবাদ পেয়ে পুত্র, মহিলা, ধনরত্ন ,সম্পদ, দাসদাসী ও অন্যান্য সকল কিছু পরিত্যাগ করে অন্তঃপুরের দুয়ার দিয়ে নৌকাপথে পলায়ন করেন। বখতিয়ার খিলজী নদীয়া দখল করে গৌড়ে গমন করেছিলেন। বখতিয়ারের নদীয়া বিজয় এ অঞ্চলে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হিসাবে ধরলেও সেই সময় মুসলিম শাসন কোন স্থায়ীত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। তাঁর নদীয়া বিজয়ের প্রায় পঞ্চাশ বছর পর মুর্গীস উদ্দীন উজবুক পুনরায় নদীয়া দখল করেন। নদীয়ায় বাংলার প্রথম মুসলমান শাসনের যে সূত্রপাত হয় তাহা প্রায় ছয়শত বছর দীর্ঘস্থায়ী ছিল।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নরপতি হিন্দুরাজা লক্ষণ সেনের রাজত্বের পতনের পর তার রাজধানী নদীয়াতে যে সব মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল তারই ক্রমবিকাশ ঘটে সমগ্র বাংলায় মুসলিম শাসনের ইতিহাস। ১২০৩ অথবা ১২০৪ সাল থেকে ১৭৬৫ সালের বৃটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর দেওয়ানী লাভ পর্যন্ত ৫৬১ বৎসরের মধ্যে মোট ৭৬ জন সুবাদার, নাজিম, রাজা ও নবাব বাংলা শাসন করে গেছেন। তাঁদের সকলের শাসনের সময় মেহেরপুর অন্তর্গত ছিল। এই শাসকদের এগার জন সুবাদার ঘোরী ও খিলজী মুসলিম সুলতানদের মনোনীত ছিল, ছাবিবশ জন স্বাধীন শাসনকর্তা অবশ্য এঁদের মধ্যে শেরশাহের আমলের শাসকগণও ছিলেন। অবশিষ্ট চৌত্রিশ জন মোগল সম্রাটদের পছন্দমত। পাঁচজন স্বাধীন রাজার মধ্যে রাজা গণেশ, জালাল উদ্দিন (যদু), শামসদ্দীন আহমেদ শাহ রয়েছেন। এই পাঁচজন এবং রাজা তোডরমল ও রাজা মানসিংহ বাদে প্রায় সকলেই আফগান, তুর্কী, ইরানী ও মোগল বংশের ছিলেন। গৌড়ের রাজা গিয়াস উদ্দীন আযম শাহের সময় ১৩৮৯ থেকে ১৪০৯ সাল গৌড়ের সকল প্রকার রাজত্ব ও শাসন ব্যবস্থার কর্মকর্তা ভাতুরিয়া পরগণার জমিদার রাজা কংস বা গণেশ গৌড় দখল করে স্বাধীন রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করেন। গণেশের পরলোকগমনের পর তাঁহার পুত্র যদু যিনি মুসলিম নাম ধারন করে মোঃ জালালউদ্দীন গৌড়ের সিংহাসন পরিচালনা করতে থাকেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সুলতান শামসউদ্দীন আহমদ শাহ উত্তরাধিকার সূত্রে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্বভার পান। মূলতঃ এই সময় থেকেই এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রচার কার্য ব্যাপকহারে শুরু হয়। শামসউদ্দীন আহমদ শাহকে নির্মমভাবে হত্যা করে ইখতিয়ার শাহী বংশের নাসির উদ্দীন মহাম্মদ শাহ গৌড় সিংহাসন দখল করেন। সুলতানী আমলে মেহেরপুর (meherpur) একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী অঞ্চল ছিল বলে জানা যায়। চৌদ্দ শতাব্দীতে মেহেরপুরে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য বেশ কিছু আউলিয়া দরবেশ এখানে আগমন করেন।

মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে মেহেরপুরের বাগোয়ানের ভবানন্দ মজুমদার (তাঁর বাল্য নাম দুর্গাদাশ সমাদ্দার) এক বিশাল রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যা ’’নদীয়া রাজবংশ নামে’’ প্রতিষ্ঠালাভ করে। নদীয়া রাজবংশ যে অঞ্চল নিয়ে জমিদারী কায়েম করে রাজ্য গড়ে তোলেন তা ’’নদীয়া’’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই সময় নদীয়া রাজ্যের জমিদারী এলাকা ছিল ৩,১৫১ বর্গ মাইল। নদীয়া রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার হুগলীর শাসনকর্তা শাহ ইসমাইল সাহেবের বদন্যতায় তিনি কানুনগো পদ লাভ করতে সক্ষম হন। পরবর্তী পর্যায়ে প্রতাপাদিত্যের সাথে যুদ্ধে মীরজা নাথান ও রাজা মানসিংহকে সাহায্য করার ফলশ্রুতিতে বাদশাহ জাহাঙ্গীরের নিকট হতে ’’ভবানন্দ মজুমদার’’ উপাধি ও জায়গীর লাভ করতে সক্ষম হন। তাঁর জমিদারীর রাজ্য ছিল লেপা, মহৎপুর, মারূপদহ, সুলতানপুর, কাসিমপুর, নদীয়া নিয়ে মোট ১৪টি পরগণা। দুর্গাদাস সমাদ্দার তাঁর পিতৃ জমিদারী তাঁর ভাই জগদীসকে কুড়ুলগাছি, হরিবলস্নভকে ফতেহপুর, টুবুদ্ধিকে পাটিক বাড়ী প্রদান করেন। তিনি নিজের দায়িত্বে রাখেন বল্লভপুর পরগণা। ভবান্দ মজুমদারের রাজ বংশের রাজা রাঘব রায় মাটিয়ার থেকে কৃষ্ণের উপাসক ছিলেন বলে জানা যায়। আর এই প্রসঙ্গ উল্লেখ্য, রাজা রাঘবের পুত্র মহারাজা রুদ্র এই স্থানটির নাম রাখেন কৃষ্ণনগর। পরবর্তীতে এই কৃষ্ণনগর নদীয়া জেলার রাজধানীতে রূপলাভ করে।

১৭৮২ সালে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নদীয়ার গদীনসীন হন। এই নদীয়ার অন্যতম অঞ্চল ছিল মেহেরপুর (meherpur) এবং রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের শাসনাধীনে মেহেরপুর দীর্ঘদিন শাসিত হয়েছে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র যথাযথ সময়ে নদীয়ার প্রচলিত খাজনা পরিশোধ করতে না পারায় নবাব মুর্শীকুলী খাঁ তাকে গ্রেফতার করেন। ১৭৫০ সালের ইতিহাস থেকে জানা যায়, মেহেরপুর শহর ষোড়শ শতাব্দীতে স্থাপিত হলেও তৎকালীন সময়েই এখানে জনবসতি গড়ে উঠেনি। কেননা, ১৭৫০ সালে মোগল শাসনের অধীন নবাবদের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৫০ সালে বাংলার সুবাদার আলীবর্দী খাঁ মেহেরপুরের বাগোয়ান গ্রামে নদীপথে আসতেন শিকার করতে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার ফলে তিনি পরিষদসহ রাজু গোঁসাই নামীয় জনৈকা এক অখ্যাত বিধবা গোয়ালা রমনীর আতিথ্য গ্রহণ করতে বাধ্য হন। নবাব আলীবর্দী খাঁ আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে ভৈরব নদীর পূর্ব তীরস্থ সমগ্র বাগোয়ান মৌজা উক্ত মহিলাকে দান করেন মর্মে কথিতআছে। রাজু গোসাই মহিলার বহু গরু ছিল। আর এই কারণে গোচারণের জন্যই বাগোয়ানের সমগ্র এলাকা তথা মেহেরপুর প্রদান করেন। তাহলে দেখা যায় সপ্তদশ শতকেও মেহেরপুর গোচারণ ভূমি ছিল। এখানে তেমন জনপদ গড়ে ওঠেনি।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের পূর্ব পযর্ন্ত রাজা গোয়ালা চৌধুরী নদীয়া সদর কৃষ্ণনগর থেকে সরাসরি মেহেরপুর পযর্ন্ত সড়ক নির্মাণ করেছিলেন। এই সড়ক নির্মাণেই মেহেরপুরের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। বর্গী দস্যূরা মেহেরপুর আক্রমণ করে বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যেতো। বর্গীদের অত্যাচার থেকে আত্নরক্ষার জন্য গোয়ালা চৌধুরীর বংশধররা ভূগর্ভে ইট দিয়ে গোপন আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করেন ও সমগ্র এলাকাকে ঘিরে পরীখা খনন করেন। মেহেরপুর পৌরসভার দক্ষিণে সেই ভূগর্ভস্থ আশ্রয় কক্ষে তার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া গেছে। এর বিলীয়মান বেশ কিছু বৃহত্তর তেঁতুল বৃক্ষ ঐ স্থানে ছিল। যে গাছ থেকে বর্গীদের আক্রমণ লক্ষ করে জনসাধারণকে সতর্ক দেয়া হতো। রাজ্য গোয়ালা চৌধুরী শেষ পযর্ন্ত ইতিহাস কুখ্যাত বর্গী দস্যু নেতা রঘুজী ভোসলার সাথে যুদ্ধে সপরিবাবে নির্মমভাবে নিহত হন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।

১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে সিরাজউদ্দৌল্লার সংগে ইংরেজদের যুদ্ধে মিরজাফরের বেইমানীতে রবার্ট ক্লাইভ জয়লাভ করায় বাংলার স্বাধীনতা অস্ত যায়। সেই প্রহসনের যুদ্ধে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ক্লাইভের পক্ষে সমর্থন করায় মিঃ ক্লাইভ যুদ্ধে জয়লাভ করে কৃষ্ণচন্দ্রকে রাজেন্দ্র বাহাদুর খেতাবে ভূষিত করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭৬৫ সালে কৌশলে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করতে সমর্থ হয়। এ সময় হতেই নদীয়া তথা মেহেরপুর ইংরেজদের শাসনাধীনে চলে যায়। ১৭৯৬ সালে নদীয়া ও যশোরের সীমানা নির্দিষ্ট হলেও পরবর্তীতে তা কয়েকবার পরিবর্তন হয়। যশোরের সংগে নদীয়া তথা কুষ্টিয়া ও মেহেরপুরের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ১৮৫৪ অথবা ১৮৫৭ সালে মেহেরপুর মুহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। অবিভক্ত নদীয়ার মহকুমা ছিল পাঁচটি যথা- কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, কুষ্টিয়া, চুয়াডাংগা ও মেহেরপুর। মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার পর মেহেরপুরে ৫ টি থানা অন্তভূর্ক্ত হয় যথা-করিমপুর, গাংনী, তেহট্র, চাপড়া ও মেহেরপুর সদর। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময়ে করিমপুর,তেহট্র ও চাপড়া ভারতে অন্তভূর্ক্ত হয়, শুধুমাত্র গাংনী ও মেহেরপুর সদর নিয়ে মেহেরপুর মহকুমা গঠিত হয়।

১৯৮৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী মেহেরপুর পূর্নাংগ জেলার মর্যাদা লাভ করেন। ২০০০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী মেহেরপুর সদর উপজেলা বিভক্ত হয়ে মুজিবনগর উপজেলার সৃষ্টি হয়। বর্তমানে মেহেরপুর জেলায় তিনটি উপজেলা রয়েছে।

মেহেরপুর জেলার ভৌগোলিক সীমানা

মেহেরপুর (meherpur) জেলা ২৩.৪৪° থেকে ২৩.৫৯° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.৩৪° থেকে ৮৮.৫৩° পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। বাংলাদেশের উচুতম জেলা গুলোর একটি হচ্ছে এ জেলা। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এর গড় উচ্চতা ২১ মিটার। এটি বাংলাদেশের পশ্চিমাংশের সীমান্তবর্তী জেলা। এ জেলার উত্তরে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলা ও পশ্চিমবঙ্গ (ভারত); দক্ষিণে চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর উপজেলা , দামুড়হুদা উপজেলা ও পশ্চিমবঙ্গ (ভারত); পূর্বে কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলা , চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলা , পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। মেহেরপুরের পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত প্রায় ৬০ কিলোমিটার ভারতীয় সীমান্ত রয়েছে।

মেহেরপুর জেলার অবস্থানঃ

আয়তন ৭১৬.০৮ বর্গ কিঃমিঃ। এটি বাংলাদেশের পশ্চিমাংশের সীমান্তবর্তী জেলা। উত্তরে কুষ্টিয়া জেলা ও পশ্চিমাবঙ্গ(ভারত), দক্ষিণে চুয়াডাঙ্গা ও পশ্চিমবঙ্গ (ভারত), পূর্বে চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া জেলা, পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ (ভারত)।

মেহেরপুর জেলার ভূপ্রকৃতিঃ

মেহেরপুর (meherpur) জেলার সমগ্র ভূ-ভাগ মৃত প্রায় ব-দ্বীপ সমভূমি এলাকা। এই এলাকার নদীগুলি দিয়ে খুব অল্প পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয়। বর্ষা ঋতুতেও প্লাবিতহওয়ার মত পানি প্রবাহিত হয় না। ফলে নতুন পলল সঞ্চয়ের সুযোগ এখানে নেই। তবে নদীগুলির গতিপথ সর্পিল বলে মেহেরপুরে অনেক অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের (Ox bow Lake) সৃষ্টি হয়েছে।

 মেহেরপুরের মোট আয়তন – ৭১৬.০৮ বর্গকিলোমিটার।

 উপজেলা ভিত্তিক আয়তন নিম্নরূপঃ

মেহেরপুর সদর – ২৬১.৪২ বর্গকিলোমিটার।

গাংনী – ৩৪১.৯৮ বর্গকিলোমিটার।

মুজিবনগর – ১১২.৬৮ বর্গকিলোমিটার।

 আয়তন শতকরা হারঃ

মেহেরপুর সদর – ৩৬.৫১%

গাংনী  –  ৪৭.৭৬%

মুজিবনগর – ১৫.৭৩%

 প্রশাসনিক এলাকাসমূহ

meherpur

মেহেরপুর জেলার অভ্যন্তরীণ মানচিত্র

দেশভাগের পূর্বে মেহেরপুর ভারতের নদীয়া জেলার অংশ ছিল। মেহেরপুর জেলা হিসাবে স্বীকৃতি পায় ১৯৮৪ সালে। বর্তমানে এ জেলায় ৩টি উপজেলা, ১৮টি ইউনিয়ন, ১৮০টি মৌজা, ২৮৫টি গ্রাম, ২টি পৌরসভা, ১৮টি ওয়ার্ড এবং ১০০টি মহল্লা রয়েছে।

উপজেলা উপজেলাওয়ারী ইউনিয়নের তালিকা

  • মেহেরপুর সদর উপজেলা – কুতুবপুর ইউনিয়ন, বুড়িপোতা ইউনিয়ন,আমঝুপি ইউনিয়ন, আমদহ ইউনিয়ন,পিরোজপুর ইউনিয়ন।
  • মুজিবনগর – দারিয়াপুর ইউনিয়ন, মোনখালী ইউনিয়ন, বাগোয়ান ইউনিয়ন, মহাজনপুর ইউনিয়ন।
  • গাংনী – কাথুলী ইউনিয়ন , তেতুঁলবাড়ীয়া ইউনিয়ন, কাজিপুর ইউনিয়ন, বামন্দি ইউনিয়ন, মটমূড়া ইউনিয়ন, ষোলটাকা ইউনিয়ন, সাহারবাটি ইউনিয়ন, ধানখোলা ইউনিয়ন, রাইপুর ইউনিয়ন।

পৌরসভা

  • মেহেরপুর পৌরসভা
  • গাংনী পৌরসভা

মেহেরপুর জেলার জনসংখ্যা

মোট জনসংখ্যা ৬,৫৫,৩৯২ জন (২০১১ সনের আদমশুমারী অনুযায়ী), পুরুষ ও মহিলার সংখ্যা ৩,২৪,৬৩৪ ও ৩,৩০,৭৫৮ জন, মোট খানার সংখ্যা ১,৬৬,৩০০টি। মুসলিম ৯৭.৭৬%, হিন্দু ১.২০%, খ্রিস্টান ১.০১%, বৌদ্ধ ০.০০২১% অন্যান্য ০.০১৯%। বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.০২% (২০১১ সনের আদমশুমারী অনুযায়ী)। এ জেলার জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতিবর্গ কিলোমিটারে ৮২১ জন। বাংলাদেশের প্রাচীন জনপদের আদলে এখানকার বসতিগুলো গড়ে উঠেছে ভৈরব, কাজলা, ছেউটি, মাথাভাঙ্গা প্রভৃতি নদীর উভয় তীরে অপেক্ষাকৃত উচূঁ জায়গায় এবং আধুনিককালে সড়কপথের দুধারে। এ ছাড়া বিল বা হাওড় অঞ্চলে পুঞ্জিভূত বা গুচ্ছ বসতিও দেখা যায়। আবাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে শহর ও ব্যবসা কেন্দ্রগুলোতে ৮৪% এবং গ্রামীণ জনপদে ৪২% পাকা ও সেমিপাকা আবাসন লক্ষ্য করা যায়।

 জনসংখ্যা,৫৫,৩৯২

পুরুষ     – ৩,২৪,৬৩৪

মহিলা    – ৩,৩০,৭৫৮

বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার  = ১.০২%

মেহেরপুর জেলার জেলার ঐতিহ্য

বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তের ছোট্ট একটি জেলা মেহেরপুর (meherpur)। এ জেলার রয়েছে প্রায় দু’হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বিশেষত ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঘটনায় মেহেরপুরের মুজিবনগর সূতিকাগারের ভূমিকা পালন করায় এ জেলার ইতিহাস হয়েছে অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। সেই মুজিবনগরের স্মৃতি বিজড়িত মেহেরপুর বাংলাদেশের জনপদগুলোর মধ্যে অন্যতম।  প্রাচীন আমল থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে এ অঞ্চলের গড়ে উঠেছে নানান স্থাপনা; তারই উল্লেখযোগ্য কয়েকটির কথা নিচে উল্লেখ করা হলোঃ

মুজিবনগর স্মৃতিকমপ্লেক্সঃ মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুর প্রাক্কালে মেহেরপুর জেলার তৎকালীন বৈদ্যনাথতালা (বর্তমানে মুজিবনগর) নামক স্থানে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করেন বাংলাদেশের প্রথম সরকার, পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। এখানে আছে বঙ্গবন্ধু তোরণ, অডিটোরিয়াম, শেখ হাসিনা মঞ্চ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকেন্দ্র, মসজিদ, হেলিপ্যাড, ২৩টি কংক্রিটের ত্রিকোণ দেয়ালের সমন্বয়ে উদিয়মান সূর্যের প্রতিকৃতিকে প্রতীক করে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, প্রশাসনিক ভবন, টেনিস মাঠ, পর্যটন মোটেল, স্বাধীনতা মাঠ, স্বাধীনতা পাঠাগার, বিশ্রামাগার, পোস্ট অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, শিশুপল্লী, ডরমেটরি ও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক বাংলাদেশের মানচিত্র। কমপ্লেক্সের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে ভাস্কর্য। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া সম্মেলন, বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠান, পাকবাহিনীর আত্নসমর্পণ, রাজাকার-আলবদর এর সহযোগিতায় বাঙালি নারী-পুরুষের ওপর পাকহানাদার বাহিনীর নির্যাতনসহ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।

ভবানন্দপুর মন্দিরঃ মেহেরপুর জেলার প্রত্ন নিদর্শনগুলোর অন্যমত সদর থানার ভবানন্দপুর গ্রামে অবস্থিত এই প্রাচীন মন্দিরটি। মন্দিরটির স্থাপত্য শৈলী দেখে অনেকে এটিকে বৌদ্ধ মন্দির হিসেবে অনুমান করে থাকেন। কিন্তু এটি হিন্দু মন্দির।

আমদহ গ্রামের স্থাপত্য নিদর্শনঃ মেহেরপুর (meherpur) জেলার অত্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ন নিদর্শন মেহেরপুর শহর থেকে ৪ কিঃমিঃ পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত আমদহ গ্রামের স্থাপত্য কীর্তি। আমদহ গ্রামের এই স্থাপত্য শৈলীর ধ্বংসাবশেষকে রাজা গোয়ালা চৌধুরীর সাথে বগা দস্যুদের যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত আবাসস্থল বলে মাসিক পত্রিকা সাধক এর ১৩২০ (১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা) সংখ্যায় উলে­খ করা হয়েছে। প্রায় এক বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই প্রত্নস্থানের চারিদিকে ছিল পরীখা, কিন্তু পরিখার বেষ্টনীতে কোন প্রাচীর ছিলনা। এখন এই প্রত্নস্থানের কোন চিহ্ন খুজে পাওয়া যায় না। তবে এখানকার মাটির নীচ থেকে উদ্ধার করা একটি প্রত্মস্তম্ভ পুরাতন জেলা প্রশাসক ভবনের সামনে স্থাপন করা হয়েছে।

বলরাম হাড়ি মন্দিরঃ ১৮ শতকের শেষের দিকে মেহেরপুর শহরের মালোপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলরাম হাড়ি নামের এক অধ্যাত্মিক সাধক। তিনি ‘উপাস’ নামে একটি ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন যার অনুসারীরা বলরামী সম্প্রদায় নামে পরিচিত। ১৮ শতকের শেষের দিকে বা ১৯ শতকের গোড়ার দিকে এ ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ হয়। ১৮৫০ সালে ৬৫ বছর বয়সে বলরাম হাড়ি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তাকে সমাহিত করা হয়। মেহেরপুরের জমিদার জীবন মুখার্জি এ সাধকের স্মৃতি রক্ষার্থে ৩৫ শতাংশ জমি দান করেন। এ জমির ওপর নির্মাণ করা হয় বলরাম হাড়ির সমাধি মন্দির।

আমঝুপি নীলকুঠিঃ নীল চাষ ও নীলকরদের দীর্ঘ ইতিহাস মেহেরপুর বুকে জড়িয়ে রেখেছে। ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত জন ফিলিপস্- এর নীলচাষ বিষয়ে রচিত গ্রন্থে বলা হয়েছে যে মশিয়ে লুই বান্নো বা বোনার্দ নামক জনৈক ফরাসী ব্যক্তি বাংলাদেশে প্রথম নীল চাষ শুরু করেছিলেন। আমঝুপি নীলকুঠি ১৮১৫ সাল অথবা এরও কিছুকাল পরে স্থাপিত হয়েছে।

ভাটপাড়ার নীলকুঠি, সাহারবাটিঃ ১৮৫৯ সালে স্থাপিত ধ্বংস প্রায় এই নীলকুঠিটি ইট, চুন-শুরকি দ্বারা নির্মাণ করা হয়। এর ছাদ লোহার বীম ও ইটের টালি দিয়ে তৈরী। এই কুঠির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কাজলা নদী।

স্বামী নিগমানন্দ আশ্রমঃ মেহেরপুর (meherpur) জেলার আরেকটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্থান হচ্ছে স্বামী নিগমানন্দ আশ্রম। হিন্দুধর্মের মহান সংস্কারক নিগমানন্দ সরস্বতীর জন্ম ১২৮৭ বঙ্গাব্দে রাধা গোবিন্দপুর গ্রামে। তার পৈতৃক নিবাস মেহেরপুরের কুতুবপুর গ্রামে। শ্রীচৈতন্য ও শংকরের দর্শনের সমম্বয়ে এক নতুন ধর্মমত প্রতিষ্ঠাকরেন। স্বামী নিগমানন্দ গৃহী হয়েও ছিলেন সন্ন্যাসী ও মানবের প্রেমে ব্যাকুল এক সাত্ত্বিক পুরুষ। ১৮ শতকের দিকে মেহেরপুর শহরে রাজা গোয়ালা চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত করেন আটচালা শিবমন্দির। মন্দিরটি বর্তমানে নিগমানন্দ সরস্বতী ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত সরস্বতী আশ্রম হিসেবে কাজ করছে।

বল্লভপুর চার্চ, ভবের পাড়াঃ ১৯২৪ সালে ভবেরপাড়ায় রোমান ক্যাথলিক চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজ আমলে নির্মিত বল্লভপুর চার্চ, ভবেরপাড়া রোমান ক্যাথলিক চার্চ এর নির্মাণশৈলীতে পাশ্চাত্য রীতি অনুসরণ করা হয়নি। এতে দেশীয় স্থাপত্যরীতি অনুসরণ করা হয়। তবে প্রযুক্তি ও স্টাইলে ইউরোপীয় স্থাপত্যশিল্পের প্রভাব ছিল।

শেখ ফরিদের দরগাহঃ মেহেরপুর (meherpur) জেলার সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ গ্রাম হল বাগোয়ান। ইতিহাসহেতা ড. ইরফান হাবিরের লেখায়, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর এর অন্নদা মঙ্গল কাব্যে ‘ক্ষীতীশ বংশাবালি চরিতাং’ গ্রন্থে এ গ্রামের কথা বলা হয়েছে। এ গ্রামে দরবেশ খান জাহান আলীর সম সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয় শেখ ফরিদের দরগাহ।

সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরঃ মেহেরপুর (meherpur) শহরের বড় বাজারে অবস্থিত সিদ্ধেশ্বরী কালি মন্দিরটিকে স্থানীয় হিন্দুরা জেলা কেন্দ্রীয় মন্দির হিসেবে গণ্য করে। জেলার সর্ব প্রাচীন এই মন্দিরটি ইতিহাসের কোন সোনালী অধ্যায়ে স্থাপিত হয়েছে তা জানা যায় না। তবে অনুমান করা হয় রাজা গোয়ালা চৌধুরী কিংবা তার পরবর্তী বংশধরেরা যশ প্রতিপত্তি বৃদ্ধির প্রত্যাশায় এ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু মন্দিরের দেওয়ালে উৎকীর্ন রয়েছে বাংলা ১৩৩২ সনে প্রফাত গোপাল সাহার স্ত্রী পাচু বালা দাসী মন্দিরটি নির্মাণ করেন। মন্দিরের ভিতরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বালা দেবীর বিগ্রহ। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী তাদের দোসররা এই মন্দির আক্রমণ করে এবং এর অভ্যমত্মরে অধিষ্ঠিত বালী মূর্তিটি গুড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর স্থানীয় হিন্দুরা পুনরায় বিগ্রহ স্থাপন করে এবং নিয়মিত পূজা অর্চনা শুরু হয়। প্রতি বছরই এখানে কালী পূজা, দূর্গাপুজা, সরস্বতী পজা অনুষ্ঠিত হয়। বৈশাখ মাসের শেষ সংক্রান্তিতে এই মন্দিরকে ঘিরে বসে বৈশাখ সংক্রান্তির মেলা। সংক্রান্তির মেলার জৌলুস আজ আর নেই; তবে নিজ ও সমাজের মঙ্গল কামনায় প্রতিবছর মন্দিও প্রাঙ্গনে চলে পাঠা বলিদান।

মেহেরপুর পৌর কবর স্থানঃ বহু বছর পূর্ব থেকে মৃতদেহ সমাহিত করার জন্য মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়ক সংলগ্ন স্থানে স্থাপিত হয় পৌর গোরস্থান।পূর্বে পৌর গোরস্থান অরক্ষিত অবস্থায় ছিল। উক্ত প্রাচীর কালের আবর্তে বিলীন হয়ে গেলে ১৯৯৩ সালে পৌর মেয়র, জনাব মোঃ মোতাছিম বিল্লাহ মতু পৌর মেয়রের আসন অলংকৃত করার পর পৌর পরিষদের সার্বিক সহযোগিতায় সুদর্শন প্রাচীর নির্মাণসহ প্রাচীরের গায়ে টাইলস্ ও পাথরের উপর আরবী এবং বাংলা কোরআন, হাদীসের বাণী লিখেন। এছাড়া এ কবরস্থানের সমস্ত জায়গায় ফুলের বাগান দ্বারা সজ্জিতকরণসহ কবর স্থানের মধ্যে ওজুখানা ও মসজিদ নির্মাণ করেন।

মেহেরপুর শহীদ স্মৃতিসৌধঃ ১৯৭১ সালে যে সব বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং যাঁরা পাকিস্থানি সৈনিদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছে তাঁদের স্মৃতি রক্ষার্থে মেহেরপুর পৌর কবরস্থানের পাশে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে প্রতি বছর মহান স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে মাল্যদান করে তাঁদের শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করা হয়ে থাকে।

মেহেরপুর জেলার ভাষা সংস্কৃতি

মেহেরপুর জেলা অবিভক্ত নদীয়া জেলার অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি জেলা। নদীয়া জেলা অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের প্রাণকেন্দ্র ছিল। মেহেরপুর জেলার ভাষা ও লোক সংস্কৃতির কিছু উদাহরণ নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ

মেহেরপুরের লোকসংস্কৃতি

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কুষ্টিয়ার লালন শাহের লালনগীতির ব্যাপক চর্চার প্রভাব মেহেরপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে প্রভাবিত করেছে। এছাড়া মেহেরপুরের লোক-সংস্কৃতি, বাউলগীতি, আঞ্চলিক গীতি, নাট্যচর্চা, ভাসানগান ও মানিকপীরের গান উল্লেখযোগ্য।

মেহেরপুর (meherpur) নদীয়ার প্রাচীন জনপদ হওয়ায় এখানে লোকসংস্কৃতি বা গ্রামীণ সংস্কৃতি বিভিন্নভাবে চর্চার মাধ্যমে ঐতিহ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। বাঙালীর সমাজ জীবনে নানা উৎসব আয়োজনে নানা ধরনের গীত, কবিগান, ভাবগান, পুঁথিপাঠ, মেঠো গান, মানসার গান, ভাসান গান, ছেলে নাচানো গান, মানিকপীরের গান, বোলান গান, অষ্টগান, গাজীর গীত ও কৃষ্ণগান সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। লোক সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রভাব ও এক শ্রেণীর প্রভাবশালী সমাজপতিদের বিদ্রুপান্তক দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ অন্তরায় সৃষ্টি করলেও বহুকাল ধরেই লোকসংস্কৃতি মেহেরপুরের সমাজজীবনে নানাভাবে বিদ্যমান রয়েছে।

  • বাউলগীতি

বৃহত্তর কুষ্টিয়ার অঞ্চল হিসেবে মেহেরপুরে কুষ্টিয়ার বাউল সম্রাট লালন শাহের প্রভাবে হাজারো বাউল অনুরাগী ও বাউল শিল্পীর সৃষ্টি হয়েছে। তারা মানবধর্মের কথা বলেন এবং দেহতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন। বাউলগণ দেহতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও মরমী গানের মাধ্যমে মানুষকে অতিন্দ্রীয়লোকে বিচরণ করাতে সক্ষম হন। মেহেরপুরে এখনো শত শত বাউল অনুরাগী তাদের ব্যক্তিজীবনে বাউল সঙ্গীত ও লালনের জীবনাদর্শ চর্চা অব্যাহত রেখেছেন।

  • কলিমউদ্দিন শাহ এর আখড়া

মেহেরপুরের (meherpur) ভৈরব নদের পশ্চিম তীরে যাদবপুরের গ্রামে জন্ম নেয়া কলিমউদ্দীন শাহ একজন বিখ্যাত বাউল সাধক। এ গ্রামে ১৪ বিঘা জমির উপর রয়েছে ‘কলিমউদ্দীন শাহের আখড়া’- যা এলাকায় ‘কালি ফকিরের আখড়া’ নামে পরিচিত। প্রতি বছর ১৪ই ভাদ্র, ২৭শে চৈত্র ও ৩০শে ফাল্গুন এ তিনটি দিবসে এখানে দেশ-বিদেশের বাউল ফকিরগণের সমাবেশ হয়। নিঃসন্তান অবস্থায় বাংলা ১৩৯১ সনের ২৭শে চৈত্র কলিমউদ্দীন শাহ ওরফে কালি ফকির মারা যান। তার নির্মিত এ আখড়ার কেন্দ্রস্থলেই তাকে সমাহিত করা হয়।

  • মানিকপীরের গান

মানিক পীর মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের গৃহস্থের নিকট সমভাবে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে আছেন।। মেহেরপুরের লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যে মানিকপীরের গান এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত। মেহেরপুরের গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে বুড়িপোতা ও পিরোজপুর ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে মানিকপীরের গানের বেশ প্রচলন রয়েছে। পৌষ মাসের সংক্রান্তিতে মানিকপীরের গান গেয়ে কেউ কেউ ভিক্ষা করে বেড়ায়। ভিক্ষার দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে ১লা মাঘ একটি নির্দিষ্ট স্থানে রান্না করে তবারক হিসেবে বিলি করা হয়।

মেহেরপুর অঞ্চলে প্রচলিত মানিকপীরের গানের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলোঃ-

‘‘মানিকের নামে তোমরা হেলা করো না

মানিকের নাম থাকলে বিপদ হবে না।
মানিকের নামে চাল-পয়সা যে করিবে দান
গাইলে হবে গরম্ন-বাছুর ক্ষেতে ফলবে ধান।’’

মানিকপীরের গানে তাঁর মাহাত্ম এ না ভিক্ষা দেয়ায় গো-মড়কের কাহিনী বলা হয়ে থাকে।

  • ভাসান গান

মেহেরপুরের (meherpur) বিভিন্ন গ্রামে ভাসান গানের দল রয়েছে। এই গানের বৈশিষ্ট হলো- তিনটি পালা করে গায়করা গান গেয়ে থাকেন। জন্মপালা, বাঁচার পালা ও মৃত্যুপালা। মৃত্যুপালা হচ্ছে শ্রোতাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। শীতকালে বাড়ী বাড়ী ভাসান গানের আসর বরে থাকে। সারা রাত ধরে এ গানের আসর চলে থাকে। ভাসান গানের মধ্যে বেহুলা স্বামী বিয়োগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে বর্ণনা দেয়া হয়ে থাকে তা শ্রোতার মনকে বিশেষভাবে আলোড়িত করে থাকে। ভাসান গানের কিছু্ অংশ এখানে তুলে ধরা হলোঃ-

‘‘ওকি সাধ আছে হে দিতে লকায়ের বিয়ে
আর কিছু দিন রাখবো ঘরে ধুলো খেলা দিয়ে।’’

  • বিয়ের গান

লোক সংস্কৃতির ভান্ডার অফুরন্ত। প্রতিনিয়ত এর উপাদান বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। আধুনিকতার উষ্ণ আবেদনের প্রেক্ষিতে অতীতের অনেক লোকসংস্কৃতি হারিয়ে গেছে। তবে মেহেরপুরের গ্রামগুলোতে অশিক্ষিত মেয়েরা বিয়ের গানের শত শত পংক্তি অনর্গল মুখস্থ বলে যেতে পারে। এ সমসত্ম গান তারা নিজেরাই সৃষ্টি করেন। মেহেরপুরের গ্রামাঞ্চলের প্রচলিত বিয়ের গান, ঢেঁকি মোঙ্গলানোর গান, ক্ষীর খাওয়ানোর গান এখানে তুলে ধরা হলোঃ-

  • বিয়ের গান

‘‘দুলাভাই গিয়েছে শহরে, আনবে নাকের নথরে
সেই নথ নাকে দিয়ে নাক ঘুরিয়ে নাচবো রে।’’

  • ক্ষীর খাওয়ানার গান

‘‘আলুয়ার চালে কাঞ্চন দুধে ক্ষীরোয়া পাকালাম

সেই না ক্ষীরোয়া খেতে গরমি লেগেছে।

কোথায় আছ বড়ভাবী পাক্কা হিলোয়ররে।’’

  • ঢেঁকি মংলানোর গান

হিন্দু বিয়েতে এ ধরনের গানের প্রচলন আছে।মেহেরপুর এলাকায় প্রচলিত গানের একটি উদাহরণ তুলে ধরা হলোঃ

ওরে লাল মোলামের ঢেঁকি তুই মাথায় সিঁদুর ওঠে

ওরে মাছ এনেছে বড় রম্নই পাঁচ মেয়েতে কোটে
লাল মোলামের ঢেঁকি কুসুম কাঠের পোয়া

ভাসুর যদি তেমন হয় ছেমায় ঢেঁকি পেতে দেয়।’’

  • শারী গান

এই গান হচ্ছে কর্ম সংগীত। মেহেরপুর অঞ্চলে শারীগানের প্রভাব আজও বিদ্যমান। পাকা ঘরের জলছাদ পেটানো কিংবা কোন ভারী কাজের জোশ সৃষ্টির জন্য শারীগান গাওয়া হয়ে থাকে।

  • জারী গান

জারীগান মূলতঃ ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে সৃষ্টি। মেহেরপুর অঞ্চলে মহররমের সময় গায়করা দলবদ্ধ হয়ে বাড়ী বাড়ী জারীগান গেয়ে বেড়ায়। যাদবপুরের বেলাল হোসেন বয়াতী জারীগানের গায়ক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। এছাড়াও অনেক জারীগায়ক দল এ অঞ্চলে রয়েছে। জারীগানের কিছু অংশ তুলে ধরা হলোঃ-

‘‘ঈমান যে না আনিবে মক্কার উপরে

গোনাগার হয়ে যাবে দোযখ মাঝারে
আরে রোমের ও শহরে ছিল
ইব্রাহীম পায়গম্বর

বহুদিবস বাদশাহী করে এই দুনিয়ার পর।’’

  • শাস্ত্র গান

একটানা বাদলার দিনে শাস্ত্রগানের কদর দেখা যায়। জমিতে নিড়ানোর সময় অথবা ধান লাগানোর সময় শাস্ত্র গান গাওয়া হয়। গ্রামের গৃহস্থের বাড়ীর বৈঠকখানায় বৃষ্টির দিনে কখনও কখনও শাস্ত্রগানের আসর বসে শাস্ত্রগানের কাহিনী অনেকটা বর্ণনামূলক। শাস্ত্রগানের উপমাঃ-

‘‘ঈমান খাঁটি ভবের খুঁটি শাস্ত্রের পরিচয়

ঈমান দিয়ে দেলকে আগে খাঁটি করা চাই,
নইলে নামাজ হবে নয়

আছে সত্য ঠিক যথার্থ তোমারে জানাই।’’

  • ভাটিয়ালী গান

মেহেরপুরের (meherpur) গ্রামাঞ্চলে এক সময় ভাটিয়ালী গানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। ইদানিংকালে অনেক কমে গেছে। গরম্নর গাড়ীর গাড়োয়ান, নৌকার মাঝি এবং মাঠের রাখালী ভাটিয়ালী গানের গায়ক হিসেবে আজও এই প্রাচীন লোকসংস্কৃতিকে ধারণ করে রেখেছে।

  • অষ্টগানঃ

চড়কপূজায় অষ্টগান পরিবেশিত হয়ে থাকে। চড়কপূজার ১৫ দিন পূর্বে পাড়ায় পাড়ায় অষ্টগানের দল বেঁধে অষ্টগান পরিবেশিত হয়ে থাকে। মেহেরপুরে অষ্টগান গাওয়ার জন্য তেমন কোন দল এখন আর নেই।

  • কীর্তনঃ

কীর্তন হচ্ছে হিন্দু বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ধর্মীয় গান। গ্রামঞ্চলে ছাড়াও মেহেরপুর শহরের বেশ কয়েকটি স্থানে এখনও নিয়মিত কীর্তনের আসর বসে থাকে। মেহেরপুরে অনেক সৌখিন কীর্তন গায়ক রয়েছেন। কীর্তন সঙ্গীত মূলতঃ খোল করতাল ও খঞ্জনী বাজিয়ে বৈষ্ণব বৈষ্ণবীরা পরিবেশন করে থাকেন।

  • পালা বা যাত্রাগান

পালা বা যাত্রাগান মেহেরপুরের সর্বত্র এখনও অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি লোকসংস্কৃতি হিসেবে বিদ্যমান। রূপবানযাত্রা, ভাসানযাত্রা, ইমামযাত্রা, আসমান সিংহের পালাগান উলেস্নখযোগ্য। শীতকালের পুরো সময় এখানকার গ্রামাঞ্চলে, এমনকি মেহেরপুর শহরের কেন্দ্রস্থলেও যাত্রাগানের আসর বসে থাকে। মেহেরপুরে সরকারিভাবে নিবন্ধিত কোন যাত্রাদল নেই। তবে কতিপয় নিবন্ধীকৃত ক্লাব রয়েছে যারা প্রতিবছরই নিয়মিতভাবে যাত্রাগানের আয়োজন করে থাকে। উল্লেখযোগ্য ক্লাবগুলো হলোঃ- রঙ্গালয় পাবলিক ক্লাব, পিরোজপুর ইয়ুথ ক্লাব, সাহারবাটি ইয়ুথ ক্লাব, আমঝুপি পাবলিক ক্লাব, বেতবাড়ীয়া ক্লাব।

  • মেহেরপুরের প্রচলিত প্রবাদ বচন

মেহেরপুরের (meherpur) সমগ্র অঞ্চলেই কমবেশি বিভিন্ন প্রবাদ ও বচনের প্রচলন রয়েছে। এ সকল প্রবাদ ও বচন সাধারণতঃ অশিক্ষিত রমণীরা তাদের দৈনন্দিন পারিবারিক জীবনে কথোপকথের প্রসঙ্গে ব্যবহার করে থাকেন। প্রচলিত প্রবাদ ও বচনের কয়েকটি উপমা এখানে তুলে ধরা হলোঃ-

(১) ‘‘গাঁয়ের মধ্যে হুলস্থুল, জানেনা আমার আবদুল।’’

(২) ‘‘ভাইয়ের ভাত, ভাজের হাত।’’

(৩) ‘‘লোহায় লোহায় এক হবে, কামার শালা পর হবে।’’

(৪) ‘‘পারেনা সুঁচ গড়াতে, যায় বন্দুকের বায়না নিতে’’

  • ছড়া গান

মেহেরপুরের ছড়াগান আজ বিলুপ্তির পথে। জারীগান গাওয়া বয়াতিরা কখনো কখনো ছড়াগান গেয়ে থাকেন।

‘‘ বন্দী খোদা বন্দী রাসুল ফাতেম

ঢাল হয়ে বসো ছেরে

তুফান লাগবে না।

  • ভাবগান

মেহেরপুরের গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয়। ভাবগানকে গ্রামে মারফতী গান বলা হয়ে থাকে ।

‘‘কবে সাধুর চরণ ধূলি লাগবে মোর গায়
আশা সিন্ধু হয়ে বসে আছি তাই।’’

  • পুঁথি গান

মেহেরপুর (meherpur) জেলায় বিভিন্ন এলাকায়পুঁথি গান প্রচলিত আছে। নিম্নে একটি উদাহরণ দেয়া হলো

‘‘ওরে ভাই বলি তাই আজব ঘটনা

ওরে সাপ খেলাই সাপুড়ের মেয়ে

নামেতে জরিনা।’’

  • পুঁথি পাঠ

মেহেরপুরের (meherpur) মুসলমানদের মধ্যে প্রাচীন আমল থেকেই পুথি পাঠের প্রচলন রয়েছে। সোনাভান, গাজী কালু চম্পাবতী, জঙ্গলনামা, ইউসুফ জুলেখা বিবি বিভিন্ন ধরনের পুঁথি মেহেরপুর অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় হয়ে আছে।

  • কবিগান

প্রেমের উপাথ্যান, বিরহ বিয়োগ ব্যাথা এমনকি দাম্পত্য জীবন নিয়ে গ্রামের অশিক্ষিত ভাষাবিদরা কবিতার ছন্দে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। এগানগুলো প্রায়ই স্বরচিত। কবিরা নিজে নিজেই গান তৈরী করে থাকে।

‘‘ কবিগান রসের সাগর ভাই

মাঝে মাঝে জোয়ার এলে পেট পুরে খাই
কবিমানে কাব্য হলো শাস্ত্রে তাই প্রমাণ দিলো

আমি বলে যাই কবিগান রসের সাগর ভাই।’’

  • ভাটিয়ালী গান

মেহেরপুর গ্রামাঞ্চলে এক সময় ভাটিয়ালী গানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। ইদানিং কমে গেছে। গরুর গাড়ী গাড়োয়ান, নৌকার মাঝি ও মাঠের রাখাল ভাটিয়ালী গান গেয়ে শুনাত।

  • গাজন গান

মেহেরপুরে চৈত্রসংক্রান্তিতে চড়ক পুজা উপলক্ষে নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে গাজন গানের প্রচলন রয়েছে। গাজনগান সাধারণতঃ দোতারা নিমিত্তে পরিবেশিত হয়ে থাকে। মেহেরপুর শহরের ঘোষ পাড়ায় একটি ঐতিহাসিক গাজনতলা আজো বিদ্যমান।

  • ব্রত কথা

হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানাদিতে ব্রত কথা বা ব্রতগীত প্রচলিত রয়েছে। যেমন ইটাকুমারের ব্রত, জামাইষষ্ঠি, পুণ্যি পুকুর প্রভৃতি ব্রত পালনের সময় ছড়া আকারে ব্রত কথা পঠিত হয়ে থাকে।

  • পুতুল নাচ

এক সময় মেহেরপুরের সর্বত্র পুতুল নাচ অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। টিকিট কেটে পুতুল নাচ দেখার জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ভীড় জমাতে দেখা গেছে। এ জেলায় বর্তমানে পেশাদার পুতুল নাচের কোন দল নেই। তবে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে এখানে পুতুল নাচ প্রদর্শন করতে আসে। পুতুল নাচ শিশু কিশোরদের বেশ আনন্দ দিয়ে থাকে।

  • মেলা

গ্রামাঞ্চল/শহরে বসবাসরত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চিত্তবিনোদনের জন্য আড়ং বা মেলা একটি অন্যতম মাধ্যম। মহররম, লাঠিখেলা, দোলযাত্রা উপলক্ষে ঝাকঝমকভাবে মেলা বসে থাকে। অজস্র মানুষ এসব মেলাতে অংশ গ্রহণ করে থাকেন।

  • নকশী কাঁথা

লোকসংস্কৃতির ইতিহাস একেবারে খাটো করে থেহার অবকাশ নেই। নকশী কাঁথা ও পাট দিয়ে হাতের তৈরী ‘‘ছিকা’’ আমাদের লোক সংস্কৃতির অমূল্য নিদর্শন বলা যেতে পারে। নকশী কাঁথা এ অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বিয়ের সময় কনের পক্ষ থেকে বর পক্ষকে উপহার দেয়া হয়ে থাকে।

  • নাচ

মেহেরপুরের লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যে নাচ একটি উল্লেখযোগ্য অবদান। গ্রামে বিয়েরবাড়ীতে বর ও কনের উভয় পক্ষের যুবক যুবতী এমনকি বুড়ো-বুড়িরা নাচে অংশ গ্রহন করে থাকেন। তবে প্রাচীন কালের তুলনায় আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে।

শিক্ষা

মেহেরপুর জেলার সাক্ষরতার হার ৫৩.৬ শতাংশ।নারীদের ক্ষেত্রে এ হার ৫১ শতাংশ এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে ৫৬.২ শতাংশ। মেহেরপুরে সরকারি কলেজ রয়েছে ৪টি, বেসরকারি কলেজ ১২টি, কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র ৬টি, কলেজিয়েট স্কুল ৫টি, সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ৩টি, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১১৪টি, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১১টি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৯৬টি, নন-রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় ৭টি এবং মাদ্রাসার সংখ্যা ৬০টি।

মেহেরপুরে পাঁচটি সরকারী কলেজ রয়েছে। এগুলো হলো:

  • মেহেরপুর সরকারি কলেজ
  • মেহেরপুর সরকারি পলিটেকনিকেল স্কুল এন্ড কলেজ
  • মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ
  • মুজিবনগর সরকারি ডিগ্রী কলেজ
  • গাংনী সরকারি কলেজ।

এছাড়াও রয়েছে

  • মেহেরপুর পৌর ডিগ্রী কলেজ
  • মহাজনপুর মহাবিদ্যালয়
  • মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজ

উল্লেখযোগ্য স্কুল হল:

  • মেহেরপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়
  • দারিয়াপুর মাধ্যামিক বিদ্যালয়
  • বাগোয়ান মাধ্যামিক বিদ্যালয়

শিল্প বাণিজ্য

অবিভক্ত নদীয়া জেলার মেহেরপুর অঞ্চল ছিল নীল চাষের অত্যন্ত উপযোগী। চল্লি­শ দশক ধরে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত মেহেরপুর প্রায় সমস্ত অঞ্চল নীল চাষই ছিল একমাত্র অর্থনৈতিক বুনিয়াদ। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মেহেরপুর থেকে রপ্তানীযোগ্য  কৃষিপণ্য হিসেবে নীল ছিল একমাত্র সম্পদ।

মেহেরপুর কৃষি প্রধান এলাকা। মেহেরপুর অঞ্চলে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। নেহাৎ প্রয়োজনের তাগিদে মেহেরপুরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট তাঁত শিল্প গড়ে উঠেছিল। মেহেরপুরের ব্যবসা বাণিজ্যের একটি বিরাট অংশ হাট বাজারের সাথে জড়িত।

কুটির শিল্প 

কুটির শিল্পে মেহেরপুর এক সময় বিখ্যাত ছিল। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কুটির শিল্পের উপর হাজার হাজার পরিবার নির্ভর করত। সেই শিল্পের অস্তিত্ব এখন বিপন্ন হয়ে উঠেছে। বর্তমানে হাতে তৈরী কাঁথা, খেজুরের পাটি, বাঁশ ও বেতের তৈরী ধামা,কুলা, কাঠা, মাদুর ইত্যাদি চোখে পড়ে। এছাড়া চুল রপ্তানির ব্যবসাকে কেন্দ্র করে মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ন ইউনিয়নের তারানগর ও জয়পুর গ্রামে গড়ে উঠেছে চুল সংগ্রহের বড় বাজার। এসব চুল দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা হয়। লম্বা চুলের চাহিদা বেশি। বর্তমানে চিন, জাপান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়ায় চুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এগুলো দিয়ে পরচুলা, কৃত্রিম চুল, চোখের ভ্রু তৈরি হয়।

মৃৎ শিল্প:

কাঁসা, পিতল, অ্যালুমিনিয়াম আবির্ভাবের পূর্বে মেহেরপুর অঞ্চলে মৃৎ শিল্পে ব্যাপক বিকাশ ঘটে। মাটির তৈরী হাড়ি, থালা, গামলা,মালসা , কলসী সর্বশ্রেণীর গৃহে ব্যবহার হতো। সেই ঐতিহ্য এখন আর নেই। তবে, কুমাররা মেহেরপুরের চাঁদবিল ও গাংনীর বিভিন্ন অঞ্চলে মাটির বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী আজও উৎপাদন করে।

শিল্প কারখানাঃ

কোন অঞ্চলের অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশের জন্য শিল্প কল-কারখারার অবদান অনস্বীকার্য। এই দৃষ্টিকোন থেকে মেহেরপুর আধুনিক প্রযুক্তিতে অত্যন্ত পশ্চাৎপদ অবস্থায় রয়েছে। স্বাধীনতা উত্তরকাল শহর অঞ্চলে কিছু কিছু স-মিল, রাইসমিল গড়ে উঠে এবং বিদ্যুতের বিস্তার লাভের কারনে গ্রামে কিছু রাইস সিল স্থাপিত হয়। বর্তমানে ইট প্রস্ত্তত কারখানা, কিছু কোল্ড ষ্টোরেজ, আইসক্রীম তৈরীর কারখানা ব্যক্তি মালিকানার উদ্যোগে গড়ে উঠেছে। এই সমস্ত কারখানায় প্রস্ত্ততকৃত দ্রব্যাদি ব্যাপকভাবে কেনা-বেচা হওয়ায় মেহেরপুরের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

কৃষি শিল্পের সম্ভাবনাঃ

মেহেরপুরের (meherpur) পলল মিশ্রিত মাটি কৃষিকাজের জন্য খুবই উপযোগী। এখানে কৃষি-সম্প্রসারন বিভাগের অধীনে মেহেরপুর সদর উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের বারাদী নামক স্থানে এবং গাংনীর বাঁশবাড়ীয়ার চিৎলা কৃষি খামার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা ফসলের বীজ উৎপাদনে এখনো ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। মেহেরপুরের সবজী সারাদেশে বিখ্যাত। এখানকার সবজী এখন দেশের সর্বত্রই রপ্তানী হয়। চাষীরা তাদের জমিগুলোতে সবজী আবাদ করে ব্যাপক উন্নতি সাধন করছে।

মেহেরপুরে কলা,আম প্রচুর পরিমানে উৎপাদন হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে হিমসাগর, ল্যাংড়া, বোম্বাই, গোপালভোগ, খিরসাপাতি, আম্রপালী বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হয়। বর্তমানে লিচুর আবাদ ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিতে সমৃদ্ধ মেহেরপুর কৃষিশিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রাকৃতিক সম্পদ

গ্যাস, কয়লা বা অন্য কোন খনিজ সম্পদ অদ্যবদি আবিস্কৃত হয় নি। তবে এ জেলার অধিক ফসল দাতা অতি উর্বর জমি, সুস্বাদু আম লিচু সহ অনেক দেশীয় ফলের বাগান এখানকার মাটির নিচে সম্পদ না থাকার অভাব পূরণ করেছে। এ ছাড়াও এ জেলার বুক চিরে বয়ে যাওয়া কাজলা, মাথাভাঙ্গা, ভৈরব ও ছেউটিয়া নদী এবং কোলা বিল, চাঁদবিলক সহ আরও অনেক খালবিল এখানকার মৎস্য সম্পদে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সহ এ সবুজ এ জেলার প্রকৃতিকে নয়ানাভিরাম করে তুলেছে।

নদনদী

নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীর ইতিহাস আর বাঙালির ইতিহাস মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। মেহেরপুর অঞ্চলের প্রধান অপ্রধান বেগবতী সব নদীই আজ নানাবিধ ভূ-প্রাকৃতিক কারণে নাব্যতা হারিয়ে মৌসুমী জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এতদঞ্চলের ভাগ্যবঞ্চিত, শোষিত নিপীড়িত জনগণের শোষণ-বঞ্চনা ও লড়াই-সংগ্রামের সঙ্গে এই সব নদীই জাগ্রত সত্তার মতো মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

একদা শুধুমাত্র নদীপথেই ছিল সমগ্র ভূ-ভারতের সঙ্গে মেহেরপুরের যোগাযোগ। কথিত আছে ১৫৮৯ সালে মোগল সেনাপতি মানসিংহ যশোরের প্রতাপাদিত্যকে দমন করার জন্য নদীপথেই মেহেরপুরের বাগোয়ানে এসে ভবানন্দ মজুমদারের সহযোগিতা গ্রহণ করেন এবং ভেরব হয়েই যশোর যান। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে এ তথ্যের সমর্থন মেলে।

“মজুন্দার সঙ্গে রঙ্গে খড়ে পার হয়ে

বাগোয়ানে মানসিংহ যান সৈন্য লয়ে।”

জনশ্রুতির ওপর নির্ভর করে ড. আশরাফ সিদ্দিকী জনাচ্ছেন, ১৭৫০ সালে নবাব আলীবর্ন্দী খাঁ নদীপথে মৃগয়ায় আসেন এই বাগোয়ান পরগনায়। দুর্যোগ কবলিত হয়ে সপরিষদ আতিথ্য গ্রহণ করেন রাজু গোয়ালিনী নামের এক নামগোত্রহীন বিধবার। আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে নবাব সেই বিধবাকে দান করেন বাগোয়ান মৌজা, আর বিধবার পুত্র গোয়ালা চৌধুরী (মতান্তরে গোপাল) কে রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন। রাজা গোয়ালা চৌধুরী এলাকার রাস্তাঘাটের যৎকিঞ্চিৎ উন্নতি সাধন করেই পড়েন সংকটে। ঐ রাস্তা ধরেই বর্গি দুস্যুরা আসে মেহেরপুরে, লুণ্ঠন করে ধনসম্পদ, এমন কি ভূতলে আশ্রয়কক্ষ নির্মাণ করেও রক্ষা পাননি গোয়ালা চৌধুরী, বর্গিনেতা রঘুজী ভোসালার হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে তাকেঁ।

অষ্টাদশ শতকের শেষ নাগাদ মেহেরপুরসহ সমগ্র নদীয়া যশোর অঞ্চলে নীলকরদের আগমন গঠে নদীপথেই। এ জেলার নদীতীরবর্তী দুতিনটি গ্রাম পরপর গড়ে তোলে নীলকুঠি। সাধারণ কৃষকের রক্তে-ঘামে উৎপাদিত হয় উচ্চমূল্য নীল। নদীপথেই তা চলে যায় ইংল্যান্ডে। শুষ্কপ্রায় নদীতীরের নীলকুঠির ধ্বংসবশেষেসমূহ এখান এ অঞ্চলের কৃষক সম্প্রদায়ের শোষণ-বঞ্চনা এবং লড়াই-সংগ্রামের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।

দিনে দিনে কালের স্রোতে হারিয়ে গেছে নদীর স্রোত। মেহেরপুর জেলার কোনো নদীকে এখন আর নদীই মনে হয়গ না। ভূ-প্রাকৃতিক নানা কারণে সব নদীই ডানা গুটিয়েছে। কেবল বর্ষাকালের অতিবর্ষণে আর বন্যার সুযোগে এই শুষ্কপ্রায় নদ নদী, খালবিল জাগ্রত এক সত্তায় উদ্ভাসিত হয়েছে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আগ্রাসী অগ্রযাত্রা রুখে দাড়িয়েঁছে বুকের বিস্তার দিয়ে, গড়েছে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ; এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধে নদীই যেন বা হয়ে উঠেছে দ্বিতীয় ফ্রন্ট। মেহেরপুরের নদীগুলোর বহুবিচিত্র বর্ণৰময় অতীয় আছে, উজ্জ্বল বর্তমান নেই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রধান-অপ্রধান নদ-নদীর বহু শাখা-প্রশাখা প্রবাহিত হয়েছে মেহেরপুরের ওপর দিয়ে। সব নদীই আজ মৃতপ্রায়। পলি জমতে জমতে জন্ম নিয়েছে এ অঞ্চলের উর্বরা পললভূমি।

ভৈরব

মেহেরপুর (meherpur) জেলার সর্বাপেক্ষা প্রাচীন এবং প্রধান নদী ভৈরব। ফানডেন ব্রোক ১৬৬০ সালে তাঁর নকশায় দেখিয়েছেন-জলাঙ্গী ও চন্দরা নামে যে দুই সহোদরা প্রমত্তা পদ্মা থেকে বেরিয়ে ভাগীরথীতে মিশেছে, তারই একটি শাখা নদী জলাঙ্গী (পশ্চিমবঙ্গে প্রবাহিত) একদা ভৈরব নামে চুয়াডাঙ্গার নিচ দিয়ে প্রবেশ করে যশোর খুলনার ভেতর দিয়ে গড়াই প্রবাহের সঙ্গে মিশে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। প্রকৃত পক্ষে চুয়াডাঙ্গার নিচ দিযে নয় জলাঙ্গী থেকে বেরিয়ে ভৈরব মেহেরপুরের শোলমারিতে সীমান্ত পেরিয়ে চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছেছে। ড. নীহাররঞ্জন রায় ‘বাংলার নদী-নদী’ গ্রন্থে ভৈরব সম্পর্কে মন্তব্য করেন, মধ্যযুগের এই নদীগুলির (চন্দনা, কুমার ও ভৈরব) মধ্যে ভৈরবও ছিল অন্যতম, কিন্তু সেই ভৈরব মনণোন্মুখ। অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র মিত্রের মতে, ভৈরব একটি তীর্থ নদ। এক সময় ইহা নামের অনুরূপ ভয়ঙ্কর মূর্তিতে বিরাজ করিত। সেই ভয়ঙ্কর রূপ যখন ছিল তখন ভৈরব পশ্চিম বাংলার মুরটি গ্রামের পাশ দিয়ে জঙ্গালী নদীকে প্রধান উৎসস্থল হিসেবে রেখে শোলমারি গ্রামে সীমান্ত পেরিয়ে মেহেরপুর জেলার কাথুলি, কুতুবপুর, মহাজনপুর, পিরোজপুর, দারিয়াপুর, যশোরের বারোবাজার হয়ে কুলনার রূপসার সাথে মিশে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এই ভৈরবের যৌবনদিনে নদীপথের সুবিধা পেয়েই এ অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠির মাঝে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে একদা খ্রিস্ট্রান মিশনারি পাদ্রিরা এসেছেন। বল্লভপুর, রতনপুর, ভবেরপাড়া প্রভৃতি গ্রামে গড়ে তুলেছেন মিশনারি প্রতিষ্ঠানসমূহে। আবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য কুঠি এবং নিষ্ঠুর নীলকরদের বহু নীলকুঠি ও গড়ে ওঠে ভৈরবতীরের গ্রামগুলোতেই। ভৈরব নদীতে পলি জমতে শুরু করে বহু আগে থেকেই। ১৮৭৩ সালে এ নদীর অংশ বিশেষ সংস্কারও করা হয়েছিল। কিন্তু তারপর আর সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে মৃতপ্রায় এ নদী ক্ষীণ একটি স্রোতধারা হয়েই বর্তমানে বিরাজ করছে। কেবল বর্ষাকালেই বেগবতী হয়ৈ ওঠে। তবে ১৯৭১ সালে ঠিক ভৈরবমূর্তি ধারণ না করলেও বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে পরাক্রমশালী প্রতিরোধযোদ্ধার ভূমিকার কারণেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে মুজিনগরের পবিত্রভুমিটুকু যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্তক মুক্ত রাখা সম্ভব হয়।

মাথাভাঙ্গা

ভৈরবে পর মেহেরপুরের (meherpur) উল্লেখযোগ্য নদী হচ্ছে মাথাভাঙ্গা। মাথাভাঙ্গাই পদ্মা নদীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা। বিচিত্র এই নদীর গতিপথ, দুচারটি গ্রাম পেরোলেই এর নাম পাল্টে যায়, স্বভাবও যায় খানিকটা বদলে। অবশ্য মেহেরপুর জেলাবাসীর সঙ্গে এ নদীর সম্পর্ক ততটা নিবিড়গ নয়, বরং বলা যায় দূর-আত্মীয়দের মতো। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার উত্তরে জলাঙ্গী নদীর উৎসমুখের প্রায় ১৬ কিলোমিটার পূর্বে পদ্মা থেকে উৎসরিত হয়ে দর্শনার পাশ দিয়ে চুয়াডাঙ্গা হয়ে আলমডাঙ্গা স্টেশনের আট কিলোমিটার পশ্চিমে এসে কুমার ও মাথাভাঙ্গা নামে দুভাগে বিভক্ত হয়েছে। তারই একটি শাখার সঙ্গে মিলিত হয়েছে দৌলতপুর থানার মধ্য থেকে কাজীপুর ও মঠমুড়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ছুঁয়ে বেরিয়ে আসা মাথাভাঙ্গা নদীর ধারা। এ দুটি জেলার মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র সড়কটিতে খলিশাকুন্ডি নামক স্থানে মাথাভাঙ্গা নদীর ওর স্থাপিত হয়েছে বেইলি ব্রিজ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা এই ব্রিজের ক্ষতিসাধনের মাধ্যমে কুষ্টিয়া থেকে মেহেরপুরের দিকে পাকবাহিনীর আগমন প্রতিহত করার চেষ্টা করে। সম্প্রতি এখানে নির্মিত হয়েছে কংক্রিটের স্থায়ী সেতু।

শিয়ালদহ থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত রেললাইন চালু হবার পূর্বে (১৮৬২) মাথাভাঙ্গা নদীপথেই কলকাতার সঙ্গে কুষ্টিয়া অঞ্চরের যোগাযোগ রক্ষিত হতো। কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর, পাবনা প্রভৃতি অঞ্চলের যাবতীয় নীলকর এই নদীপথেই তাদের নীল কলকাতায় পাঠাত। ব্রিটিশ আমলেই মাথাভাঙ্গা নদী নাব্যতা হারাতে থাকে। ফলে নীলকর পড়ে সংকটে। সরকারের কাছে দেনদরবার করে তারা ১৮২০ সালে মাথাভাঙ্গা সংস্কারেরও উদ্যোগ নেয়। উইলিয়াম হান্টারের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, রবিনসন এবং মে নামক দু’জন নদী সংস্কারকের ছয় বছরের প্রচেষ্টাতেও বিশেষ কোনো ফল হয়নি। দিনে দিনে পলি জমার কারণে মাথাভাঙ্গার বুক অনেকাংশে ভরাট হয়ে এলেও এ নদীর মূল প্রবাহ এখনো সামান্য গতিশীল রয়েছে।

ছেউটি

মেহেরপুর (meherpur) জেলার গাংনী থানার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অপর একটি ছোট নদী ছেউটি। স্থানীয় মানুষ তাকে মরা গাঙও বলে। ছেউটি মূলত মাথাভাঙ্গারই একটি ক্ষীণকের শাখা। কিন্তু এ নদীর দুই মাথাই এখন মৃত। তেরাইল বিল থেকে বেরিয়ে এসে মালশাদহ, হাড়িয়াদহ, ধানখোলা, বারাদি গ্রামের পাশ দিয়ে দীনদত্তের কাছে দিয়ে মাথাভাঙ্গায় পড়েছিল ছেউটি। কিন্তু এ নদীর দক্ষিণের এই মুখটিও পলিভরাট রুদ্ধ হয়ৈ গেছে। ফলে প্রবাহমান কোনো নদীর সঙ্গেই ছেউটির আর কোনো সম্পর্ক নেই। বর্ষা মৌসুম ছাড়া অন্য কোননো সময়ে এই মরাগাঙে মোটেই পানি থাকে ন।

কাজলা

গাংনী থানার আরো একটি মৃতনদী কাজলা। কাজীপুর ইউনিয়নে মাথাভাঙ্গা তেকে বেরিয়ে নপাড়া, ভাটপাড়া, সাহারবাটি, গাড়াডোব হয়ে আমঝুপিতে বাঁকবদল করে কাজলা এক সময় গিয়ে পড়েছিল ভৈরবে। কাজলা নদীর দুইপাড়ে নীলকররা গড়ে তুলেছিল অনেকগুলো নীলকুঠি। কিন্তু এই ক্ষুদ্র নদীটির নাব্যতা অনেক আগেই হারিয়ে যায়। বর্তমানে পুরো কাজলার বুকেই চাষবাদ হয়। বর্ষাকালে খাল বিলে পানি জমার মোত এখানেও পানি জমে।

স্টুয়ার্ট খাল

গাংনী থানার ভাটপাড়ার নিচ দিয়ে প্রবাহিত একটি মরা খাল হিজলবাড়িয়া, ডোমরদহ, দুর্লভপুর, তেরাইল হয়ে বহব্বতপুর, কামারখালি, সিঁদুরকৌটা, বাদিয়াপাড়া প্রভৃতি গ্রামের মধ্য দিয়ে খলিশাকুণ্ডিতে মাথাভাঙ্গা নদীতে মিশেছে। বর্মমানে এ খালও মৃতপ্রায়। কথিত আছে ভাটপাড়া নীলকুঠির সর্বশেষ ম্যানেজার জন স্টুয়ার্ট এই খাল পুনকননের কাজ করেন বলে একে স্টুয়ার্ট খাল বলা হয়। নীল পরিবহনের স্বার্থেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়। এখন নীল চাষও নেই, স্রোতস্বিনী খালও নেই, কিন্তু জন স্টুয়ার্টের নামটি এলাকাবাসীর মুখে মুখে আছে।

মড়কা খাল

স্টুয়ার্ট খালের মতোই সংক্ষিপ্ত পরিসরের মড়কা খাল গাংনী থানার সিঁদুরকৌটা গ্রামের কাছে মাথাভাঙ্গা নদী থেকে বেরিয়ে খাষ্টদহ বিল হয়ে শিমুলতলা, হাড়িয়াদহ হয়ে ধানখোলার কাছে এসে ছেউটি নদীর সঙ্গে মিশেছে। ২৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই খালে বর্ষাকাল ছাড়া পানি থাকে না। তবু অনেকেই আজো আদর করে মড়কা নদী বলে। রাইপুর গ্রামের কাছে এই মড়কা খালের ওপর একটি ব্রিজ দিয়ে গাংনী থেকে আলমডাঙ্গা পর্যন্ত সড়কপথকে সংযুক্তি করা হয়েছে।

মেহেরপুর (meherpur) জেলার প্রধান-অপ্রধান সব নদী আজ মৃতপ্রায়। আগামী প্রজন্ম হয়তো জানবেও না-এই সব নদীও একদা স্রোতস্বিনী ছিল। দেশ-বিদেশের ছোট-বড় নৌকা, বজরা, জাহাজ সেই স্রোতে ভেসে এই জনপদে এসেছে, নবাব আলীবর্দী খাঁ, সেনাপতি মানসিংহেরও এই নদীপথেই আগমন ঘটেছে বাগোয়ান। নদী নেই। স্রোতধারার গতিপরিবর্তনের সময় নদী তার নিজের অজান্তে ও অনিচ্ছায় যে সমস্ত পুরাতন খাত তৈরি করেছিল সেই সব কোল, ডামোশ বা দহতেও সারা বছর পানি থাকে না, তবু আমদহ, মালশাদহ, হাড়িয়াদহ, ভোমরদহ প্রভৃতি গ্রামগুলি তার নামের শেশে ‘দহ’ লেজুড়ের সঙ্গে ইতিহাসের স্রোতধারাও বয়ে চলেছে।

খেলাধূলা বিনোদন

প্রাচীনকাল থেকেই মেহেরপুরে ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলা হয়ে আসছে। এর মধ্যে হা-ডু-ডু, ডাংগুলি, গাদন, মার্বেল, লাঠিখেলা, মালখেলা, নৌকাবাইচ, ঘুড়ি উড়ানো উল্লেখযোগ্য। দাবা, তাস, লুডু, বাঘবন্দী, পাশা খেলা এ অঞ্চলে বহুকাল ধরেই চলছে। উনিশ শতকের দিকে আধুনিক খেলার মধ্যে ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, টেনিস, টেবিল টেনিস খেলা মেহেরপুরে চলমান আছে। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলার সাথে বর্তমানে মেহেরপুরের আধুনিক খেলার মান এবং অনুশীলন বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সাত খোলাম, চোর-ডাকাত, খেটি, ডাংগুলি, মার্বেল, সাল, লুকোচুরি ইত্যাদি খেলাগুলো একেবারেই বিলীন হয়ে গেছে।

হাডুডু খেলা

সবচেয়ে কম খরচে এবং স্বল্প আয়োজনে কোপানো নরম মাটির উপর এ খেলা হয়ে থাকে- যা প্রায় কাবাডি খেলার মতই। প্রাচীনকাল থেকেই মেহেরপুরের শহর ও গ্রামাঞ্চলে হাটবাজার ও পাড়ায়-মহল্লায় ব্যাপকভাবে হা-ডু-ডু খেলার প্রচলন ছিল। তবে এখন আর তেমনভাবে এ খেলা হয় না। গ্রামাঞ্চলে কদাচিৎ পাড়ায় পাড়ায় এবং কখনও বা প্রতিযোগিতামূলক আয়োজনে এ খেলা দেখা যায়। আর এ সকল প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে গরু বা খাসি ছাগল দেয়ার প্রচলন আছে। একসময়ে মেহেরপুরে হা-ডু-ডু খেলার অনেক খেলোয়াড় থাকলেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বা পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে জাতীয় পর্যায়ে মেহেরপুরের (meherpur) কোন সাফল্য বা নাম হয়নি। প্রখ্যাত হা-ডু-ডু খোলোয়াড় হিসেবে মেহেরপুরের আমঝুপি গ্রামের মোঃ জমিরুল ইসলাম ও দিঘীড়পাড়া গ্রামের মোঃ আব্দুল গনির নাম এতদঞ্চলে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো। এমনকি ওপার বাংলাতেও তাঁদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল।

ক্রিকেট খেলা

মেহেরপুরে (meherpur) ক্রিকেট খেলা অত্যমত্ম জনপ্রিয়। একসময় মেহেরপুর শহরে ও আমঝুপি গ্রামে শক্তিশালী ক্রিকেট টিম ছিল। প্রতিবছরই আশেপাশের বিভিন্ন জেলার টিমগুলোর সাথে তাদের সফর বিনিময়ের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক এক দিনের ক্রিকেট ম্যাচ এবং প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হতো। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এখান থেকে জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড় তৈরি হবে।। মেহেরপুরের উজলপুর গ্রামের ইমরুল কায়েস জাতীয় পর্যায়ে টেস্ট ক্রিকেট, এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ ও টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে প্রায় নিয়মিতই খেলছেন।

ফুটবল

ফুটবল খেলা মেহেরপুরে ঊনিশ শতকের প্রথম দশকে শুরু হয়েছে বলে প্রবীণ খেলোয়াড়দের কাছ থেকে জানা যায়। বাতালী লেবুকে ফুটবল হিসেবে ব্যবহার করে খেলা করার প্রবনতা চালু ছিল দীর্ঘকাল ধরে। এরপর ১৯৩৯ সালে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক প্রথম মেহেরপুরে (meherpur) টাউন ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। এই ক্লাবের তত্ত্বাবধানে বর্তমানের মেহেরপুর স্টেডিয়াম মাঠে ফুটবল খেলা শুরু হয়।। সুভাস বিশ্বাসের বাসের ড্রাইভার ত্রিদেব ঘোষাল তৎকালীন সময়ে ফুটবল খেলার একজন নিষ্ঠাবান সংগঠক ছিলেন। বর্তমানের স্টেডিয়াম মাঠের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মেহেরপুর হাইস্কুলের অপর একটি মাঠ ছিল- যা পরবর্তীকালে টাউন মাঠের সাথে বিলুপ্ত হয়ে যায়। হাইস্কুলের সামনের বর্তমান মাঠটি ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৩০ সালের দিকে বর্তমান ওয়াপদা সড়কের উত্তর দিকে কচা বাগানে একটি ফুটবল মাঠ ছিল- যা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তরুণ বঙ্গ সমাজ নাট্যক্লাবের সদস্যরা এ মাঠে নিয়মিত ফুটবল খেলতেন।। টাউন মাঠের (বর্তমানে স্টেডিয়াম মাঠ) জমি মোহর আলী মোক্তার ও ইন্দুভূষণ মল্লিক যৌথভাবে দান করেছেন। ১৯৩৯ সালে টাউন মাঠে টিনসেড দিয়ে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক এ, রহমানের উদ্যোগে অস্থায়ীভাবে একটি ঘর নির্মাণ করা হয়। এর নামকরণ হয়- রহমান স্টেডিয়াম।

টিনের এ ঘরটি ১৯৯০ সালে সরকারিভাবে ভেঙে দিয়ে সেখানে প্যাভিলিয়ন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এর পূর্বে ১৯৮৩ সালে ফুটবল মাঠের বেস্টনী প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। অবিভক্ত নদীয়া জেলার মেহেরপুর (meherpur) মহকুমায় তৎকালীন সময়ে যাঁরা কৃতি ফুটবল খেলেয়াড় ছিলেন তাঁরা হলেন- নুর বক্স, প্রভাস চন্দ্র, সামসুজ্জোহা, ফেনু শেখ, কায়েম বক্স, গনেশ ভট্টাচার্য, নফর ঘোষ, আবু হোসেন, আলতাফ, আব্দুর রউফ, ফেরাতুল ইসলাম, ইছহাক মিয়া প্রমুখ।

লাঠি খেলা

ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে বরেন্দ্রভূমির বিদ্রোহী কৈবত্তদের দলপতি দিব্যপাল প্রাথমিক হাতিয়ার লাঠিকে ব্যবহার করে তৎকালীন দ্বিতীয় পাল বংশের রাজধানী গৌড় দখল করেছিলেন। খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকের পূর্বে পাকভারত উপমহাদেশের যুদ্ধে হাতিয়াররূপে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ছিল না। তখন দেশী অস্ত্র-উপকরণ ব্যবহৃত হতো। সৈন্যদলের পাশ্চাত্যভাগ সাধারণতঃ লাঠি বা বল্লম হাতে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হতো। অর্থাৎ তখনকার সময়ে যুদ্ধে লাঠিকে প্রাথমিকভাবে ব্যবহার করার কথা অনুমান করা হয়ে থাকে। ঊনবিংশ শতকে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে ফকির ও সন্ন্যাসীগণ প্রথম অস্ত্ররূপে লাঠিকে বেছে নেয় । নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে অত্যাচরিত কৃষকরা লাঠি হাতেই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। কোন কোন ক্ষেত্রে বিজয়ী হয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। বাংলার প্রাচীনতম ঐহিত্যময় লাঠিখেলার বিশাল ইতিহাস মেহেরপুরে (meherpur) ছড়িয়ে রয়েছে।

মেহেরপুরের (meherpur) আলহাজ্ব ডাঃ দীল মোহাম্মদ ১৯৭২ থেকে ১৯৮৩ সাল পযর্ন্ত বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর সভাপতি ছিলেন। তাঁর দাদা শেখ শের আলী ও পিতা শেখ নিয়ামতুল্লাহ মেহেরপুরের প্রখ্যাত লাঠিয়াল ওস্তাদ ছিলেন। আলহাজ্ব ডাঃ দীল মোহাম্মদ বগুড়ার ন্যাশনাল স্কুল থেকে সনদপ্রাপ্ত ডাক্তার ছিলেন। পেশাগত জীবনে তিনি স্বাস্থ্য পরিদর্শকের চাকরি করতেন।

জানারম্নদ্দিন মেহেরপুরের অপর একজন বিখ্যাত লাঠি খেলোয়াড়। পেশাগত জীবনে তিনি তহসিলদারের চাকরি করতেন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তিনি লাঠিখেলা প্রদর্শন করেন।

মাল খেলা বা কুস্তি খেলা

প্রাচীন সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী মাল বা কুস্তি খেলা এক অনবদ্য নৈপূণ্যসম্পন্ন খেলা। এক সময় মাল খেলা মেহেরপুরে (meherpur) অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। ১৯৪৫ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত মেহেরপুরে মাল খেলার প্রচলন লক্ষ্যনীয় ছিল। পরবর্তীতে ক্রমে ক্রমে এর বিলুপ্তি ঘটেছে। মেহেরপুরের আছের মাল, বল্লভপুরের বিমল মল্লিক, ফতেপুরের ঝড়ু শেখ, কাঁঠালপোতার চমৎকার মাল, আশরাফপুরের ফকির ও করিম মাল, সাহেবপুরের ক্ষুদি বিশ্বাস মেহেরপুরের প্রখ্যাত মাল খেলোয়াড়। আছের মাল কোলকাতার জনৈক ইউসুফ খানের কাছে মাল খেলা রপ্ত করেন। তিনি মালখেলায় বিভিন্ন পুরস্কার জিতে খ্যাতিলাভ করেছিলেন।। মালখেলায় পারদর্শী ব্যক্তিরা অনেক সময় অর্থের বিনিময়ে জমি দখল, দাঙ্গা ও মারামারির কাজে লিপ্ত হওয়ার কাহিনী শোনা যায়।

টেনিস

মেহেরপুরে (meherpur) ১৯৪৫ সাল থেকে টেনিস খেলার প্রচলন রয়েছে। সে সময় জেলা পরিষদের পিছনে টেনিস খেলার জন্য একটি গ্রাস কোর্ট করা হয়েছিল। তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক এই গ্রাস কোর্টটি করেছিলেন বলে অনুমান করা হয়। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক রুহুল কুদ্দুস মেহেরপুর পাবলিক লাইব্রেরি প্রাঙ্গনের বর্তমান মাঠটি নির্মাণ করেন। ১৯৮৫ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আবু ওয়াহিদ মেহেরপুর সদর উপজেলা পরিষদ ক্যাম্পাসে একটি মাঠ নির্মাণ করেন। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এবং খেলাধূলা না হওয়ায় এ মাঠটি নষ্ট হয়ে গেছে। মেহেরপুর পাবলিক লাইব্রেরি প্রাঙ্গনের মাঠটিতে সারা বছরই খেলা চলে এবং বিভিন্ন টেনিস টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়

মেহেরপুর জেলার ঐতিহাসিক প্রাচীন স্থানসমূহ

  • করমদী গোসাঁইডুবি মসজিদ
  • শিব মন্দির , বল্লভপুর
  • বরকত বিবির মাজার
  • বাঘুয়াল পীরের দরগা
  • ভাটপাড়া ও আমঝুপি নীলকুঠি
  • মুজিবনগর বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী
  • সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির
  • ভবানন্দপুরমন্দির
  • আমদহ গ্রামের স্থাপত্য

মেহেরপুর জেলার দর্শনীয় স্থান

  • মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ
  • পৌর ঈদগাহ
  • মেহেরপুর শহীদ স্মৃতিসৌধ
  • আমদহ গ্রামের স্থাপত্য নিদর্শন
  • সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির
  • আমঝুপি নীলকুঠি
  • ভাটপাড়া নীলকুঠি
  • ভবানন্দপুর মন্দির
  • কালাচা‍দপুর শাাহ ভালাই এর দরগা
  • বল্লভপুর চার্চ
  • ভবরপাড়া রোমান ক্যাথলিক চার্চ
  • নায়েব বাড়ি মন্দির
  • স্বামী নিগমানন্দ সারস্বত আশ্রম

মেহেরপুর জেলার প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব

  • এম. এ. হান্নান- মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপত
  • শাহ আলম- ক্রীড়াক্ষেত্রে অবদানের জন্য মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপত
  • ইমরুল কায়েস- ক্রিকেটার, বাংলাদেশ জাতীয় দল
  • ভবানন্দ মজুমদার – নদিয়া রাজপরিবারএর প্রতিষ্ঠাতা
  • রাখী গুলজার- অভিনেত্রী
  • জগদীশ্বর গুপ্ত – বৈষ্ণব পদকর্তা
  • কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী – কবি
  • মুন্সি শেখ জমিরউদ্দীন- ধর্মসংস্কারক
  • রমণীমোহন মল্লিক – বৈষ্ণব পদকর্তা
  • ড. মোঃ মোজাম্মেল হক – পদার্থবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ
  • প্রসেনজিৎ বোস বাবুয়া- সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
  • ওয়ালিল হোসেন- বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা
  • আ.ক.ম.ইদ্রিস আলী- মুক্তিযোদ্ধা,বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ
  • আসিফ আজিম- মডেল,অভিনেতা
  • মোঃ আব্দুল মজিদ – পরমাণু বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন

বিঃদ্রঃ এখানে দেওয়া সকল তথ্য ইন্টারনেট এর বিভিন্ন তথ্যমূলক ওয়েবসাইট ও স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দেওয়া হয়েছে। যদি কোনো তথ্যে ভুল থাকে তাহলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং সঠিক তথ্য দিয়ে ভুল টা সংশোধন করার জন্য আমাদের সাহায্য করবেন এবং এই তথ্য টি পরে যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে তথ্যটি শেয়ার করবেন ।

তথ্যসূত্র:
স্থানীয় লোকজন
https://bn.wikipedia.org

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here