পিরোজপুর জেলায় বেশ কিছু পুরাকীর্তি স্থাপনা রয়েছে। এসব স্থাপনা ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের বেশ আকৃষ্ট করে। তেমনই একটি স্থাপনা ‘রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি’ (Rayerkathi Jomidar Bari)। বাংলাদেশ এর পিরোজপুর জেলার পিরোজপুর সদর উপজেলার রায়েরকাঠি গ্রামে অবস্থিত এক ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি। প্রায় ৩৫০ বছর আগে উৎপত্তি হয়েছিল জমিদার বংশের, আর সেই সুবাদেই এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় এই জমিদার বাড়িটি। এই জমিদার বাড়িতে রয়েছে একটি কালীমন্দির ও শিবমন্দির। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রাজা রুদ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী রাজবাড়ি ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মূল রাজবাড়িটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও কালের সাক্ষী হয়ে আছে ৩৫৭ বছরের পুরোনো কালীমন্দির এবং ৭৫ ফুট উচ্চতার ১১টি মঠ।
এই জমিদার বাড়িতে নির্মিত হয় রাজভবন, নহবৎখানা, অতিথিশালা, নাট্যশালা এবং অসংখ্য মন্দির। রাজবাড়ীতে ছিলো ছোট বড় প্রায় দু’শ অট্টালিকা। তারমধ্যে ৪০ বা ৫০টি গগণচুম্বী অট্টালিকা রাজবাড়ির শোভাবর্ধন করতো। বর্তমানে ভালো এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত মিলিয়ে ৭টির মত ভবন রয়েছে। জমিদার বাড়িতে ১৬৫৮ সালে কালিমন্দির নির্মাণ করা হয়। এখানে রয়েছে প্রায় ২৫ মণ ওজনের শিব লিঙ্গ। এটি উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ শিবলিঙ্গের একটি। এছাড়া এখানে বর্তমানে শিব মন্দির রয়েছে ১০টির মত।
রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ির ইতিহাস (Rayerkathi Jomidar Bari)
ভারতবর্ষে মোগল সম্রাট শাহজাহান শাসনামলে পিরোজপুরের রায়েরকাঠি নামক জায়গা এই জমিদার বাড়িটির গোড়াপত্তন হয়। মূলত এখানে বন-জঙ্গল ছিল। এগুলো পরিষ্কার করেই এখানে এই বাড়িটি তৈরি করা হয়। যার ফলে এখানের নামকরণ করা হয় রায়েরকাঠি। মোগল সম্রাটের শাসনামলে যুবরাজ সেলিম অর্থাৎ সম্রাট জাহাঙ্গীর বিদ্রোহ করে বর্তমান পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও বাগেরহাট জেলার কিছু অংশ নিয়ে “সেলিমাবাদ” নামে একটি পরগণা সৃষ্টি করেন। পরবর্তীতে তিনি উক্ত এলাকার রাজস্ব আদায়ের জন্য মোদন পালকে দায়িত্ব দেন। মোদন পাল আবার তার ছেলে শ্রীনাথকে উক্ত রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেন। রাজস্ব আদায়ের জন্য শ্রীনাথ বর্তমান ঝালকাঠির লুৎফুবাদ নামক গ্রামে একটি কাছারিঘর স্থাপন করেন এবং সেখান থেকে অতি সু-দক্ষতার সাথে রাজস্ব আদায়ের কাজ পরিচালনা করতে থাকেন। যার ফলস্বরূপ তিনি মোগল সম্রাটের কাছ থেকে “রাজা” উপাধি লাভ করেন। এরপর রাজা শ্রীনাথের ছেলে রুদ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী বর্তমান পিরোজপুরের রায়েরকাঠি এলাকায় বিশাল বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে জমিদার বাড়ি (Rayerkathi Jomidar Bari) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি জমিদার বাড়ি তৈরির সময় কালী মন্দিরও তৈরি করছিলেন। এই কালী মন্দির তৈরি করতে গিয়ে তিনি তখনকার সময়ের নিম্নবর্ণের হিন্দু পাঁচজনের মুণ্ডু কেটে তার উপর মূর্তি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তার এই নিষ্ঠুর কার্যক্রমের কথাটি ঢাকার প্রাদেশিক সুবেদার শাহবাজ খানের কানে যায়। এতে তিনি রাগান্বিত হয়ে বিচার করে রুদ্র নারায়ণকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। যা হাজার হাজার মানুষের সামনে বাঘের খাঁচায় তাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি খাঁচার মধ্যে বাঘের সাথে লড়াই করে বাঘকে মেরে ফেলেন। এ খবর সুবেদারের কাছে গেলে তিনি রুদ্র নারায়ণের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে দেন। এতে রুদ্র নারায়ণ তার এই নিষ্ঠুর কৃতকর্মে লজ্জিত হয়ে জমিদার বাড়িতে না ফিরে ছেলে নরোত্তম নারায়ণ রায়কে জমিদারীত্ব দিয়ে কাশি চলে যান। সেখানে তিনি আমৃত্যু সন্ন্যাস জীবন পালন করেন।
পিরোজপুর শহর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে রায়েরকাঠি গ্রামে রাজবাড়িটির অবস্থান। ২০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজবাড়ির পূর্ব দিকে রয়েছে কালীমন্দির ও শিবমন্দির। রাজপ্রথা বিলুপ্তির পরে চালু হয় জমিদারি প্রথা। আর রুদ্র নারায়ণের উত্তরসূরিরা রাজা থেকে পরিণত হন জমিদারে। একসময় রাজবাড়িতে মহিষ বলি দিয়ে ঘটা করে কালী পূজা হতো। তবে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর রাজবাড়ি তার জৌলুশ হারায়।
বর্তমানে অযত্ন ও অবহেলার কারণে এখন আর তেমন কিছু আর অবশিষ্ট নেই এখানে। রাজবাড়ির প্রধান ফটক, রাজাদের বসবাসের বহুতল ভবনগুলো, বিচারালয়, কাচারিঘর, জলসাঘর, অন্ধকূপ ভেঙে গেছে। মোগলদের মন্দিরের নকশায় নির্মিত মঠগুলোও নষ্টের পথে। মঠের দেয়ালে মাটির অলংকরণ ক্ষয়ে এর গায়ে শেওলা ও লতাপাতা জন্মেছে। নবরত্ন মঠসহ তিনটি মঠের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। একটি মঠে সংরক্ষিত আছে কষ্টিপাথরের মহামূল্যবান শিবমূর্তি।আর যেগুলো রয়েছে, সেগুলোও প্রায় ধ্বংসের মুখে। দেয়ালে লতাপাতা, গাছগাছালি ও শ্যাওলায় জরাজীর্ণ হয়ে রয়েছে।
যেভাবে যাবেন:
বাসে বা নৌপথে পিরোজপুর যাওয়া যায়। বাসে ঢাকা বা যেকোনো জায়গা থেকে প্রথমে পিরোজপুর শহরে আসতে হবে। জমিদারবাড়িটি পিরোজপুরের মূল শহরে অবস্থিত হওয়ায় রিকশা, অটো রিকশা নিয়ে ‘রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি’ যাওয়া যায়।
এছাড়া সদরঘাট থেকে লঞ্চে করেও যাওয়া যাবে পিরোজপুর। হুলারহাট ঘাট থেকে অটোরিকশা করে পিরোজপুর হয়ে রায়েকাঠি যেতে হবে। জনপ্রতি ভাড়া দিয়ে অথবা রিজার্ভ অটোরিকশা নিয়ে চলে যেতে পারবেন জমিদার বাড়ি ভ্রমণে।
রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ির কিছু ছবি
বিঃদ্রঃ এখানে দেওয়া সকল তথ্য ইন্টারনেট এর বিভিন্ন তথ্যমূলক ওয়েবসাইট ও স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দেওয়া হয়েছে। যদি কোনো তথ্যে ভুল থাকে তাহলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং সঠিক তথ্য দিয়ে ভুল টা সংশোধন করার জন্য আমাদের সাহায্য করবেন এবং এই তথ্য টি পরে যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে তথ্যটি শেয়ার করবেন ।