চুয়াডাঙ্গা জেলা (chuadanga) বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। ১৮৫৯ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি কোলকাতা-কুষ্টিয়া রেলপথ নির্মাণ শুরু করে তৎকালীন নদীয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমা এবং যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার সাথে কোলকাতার যোগাযোগ স্থাপনের জন্য দুই মহকুমার মিডল পয়েন্ট চুয়াডাঙ্গাতে ১৮৬০ সালে বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন নির্মিত হয়েছিল। ১৮৬২ সালে ১৫ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন চালু হলে ১৮৫৯ সালে গঠিত দামুড়হুদা মহকুমা বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা জেলার একটি উপজেলা থেকে মহকুমা সদর এবং কালুপল থেকে থানা চুয়াডাঙ্গায় স্থানান্তর করা হয়। যার ফলে চুয়াডাঙ্গা তখন নদীয়া জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ মহকুমা এবং বড় ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে আন্তপ্রকাশ ঘটে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় চুয়াডাঙ্গা মহকুমা কুষ্টিয়া জেলার সাথে সংযুক্ত হয়। ১৯৮৪ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলা কুষ্টিয়া থেকে ভাগ হয়ে একটি সতন্ত্র জেলা হিসাবে আন্তপ্রকাশ ঘটে। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সর্বপ্রথম কমান্ড দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ড গঠিত হয়েছিল চুয়াডাঙ্গায়। মুক্তিযুদ্ধের আট নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল চুয়াডাঙ্গা সদরের ৪নং ইপিআর এর হেডকোয়ার্টার। ৪নং ইপিআর প্রধান মেজর আবু ওসমান চৌধুরী এবং ডাঃ আসহাব-উল-হক জোয়ার্দ্দার একই দিন সকাল ৯:৩০ এ চুয়াডাঙ্গা শহরের বড় বাজার চৌরাস্তার মোড়ে সর্বপ্রথম দখলদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ রেডক্রস বর্তমানে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি চুয়াডাঙ্গাতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের ডাক বিভাগ এবং টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা এই চুয়াডাঙ্গায় প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১০ই এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার চুয়াডাঙ্গা কে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করেন। এবং ১৬ই এপ্রিল পর্যন্ত তা কার্যকর ছিলো। পরবর্তীতে নিরাপত্তার কথা ভেবে রাজধানী মেহেরপুরের বৌদ্দনাথ তলায় বর্তমানে মুজিবনগর এ সরিয়ে নেওয়া হয়। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর ব্রিটিশরা ভারতের (অধুনা বাংলাদেশের) প্রথম রেল পথ চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়া জেলার জগতী পর্যন্ত চালু করেন। চুয়াডাঙ্গার রেলওয়ে স্টেশন হল বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন।
চুয়াডাঙ্গা জেলার পটভূমি (chuadanga)
চুয়াডাঙ্গা (chuadanga) জেলার প্রাচীন ইতিহাস প্রায় অজ্ঞাত। গ্রীক ঐতিহাসিকদের বিবরণ ও টলেমির মানচিত্র থেকে অনুমান করা হয় বর্তমান চুয়াডাঙ্গা জেলা সর্বপশ্চিমে ধারার (এবং তা ভগীরতী ও হতে পারে) অব্যবহিত পূর্বদিকেই ছিল। যশোর ও গোপালগঞ্জ জেলায় আনুমানিক চতুর্থ শতাব্দীর যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে, তাতে প্রমানিত হয় যে, গঙ্গা – পদ্মার দক্ষিণ তীরের ভূখন্ড বেশ প্রাচীন। সুতরাং এ ধারণাও যুক্তিসঙ্গত যে, বর্তমান চুয়াডাঙ্গা জেলা সেই প্রাচীন ভূখন্ডের অংশ বিশেষ। প্রাপ্ত তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, কুমিল্লা থেকে সুদূর উড়িষা পর্যন্ত এ রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল। চুয়াডাঙ্গা যে সে রাজ্যের অর্ন্তভুক্ত ছিল তাতে সন্দেহ নেই। তখন এ অঞ্চল সমতট বা বঙ্গ নামে পরিচিত ছিল। ধারনা করা হয় চুয়াডাঙ্গা এক সময় শশাঙ্কের রাজ্যভুক্ত ছিল। বল্লাল সেনের (১১৬০ – ১১৭৮ খ্রি:) আমলে চুয়াডাঙ্গা সেন রাজ্যভুক্ত ছিল। ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবান বাঙলার শাসনকর্তা মুঘীসউদ্দিন তোঘরীকে পরাজিত ও নিহত করে বর্তমান চুয়াডাঙ্গাসহ সমগ্র বাংলাদেশকে তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। ১৪১৪ সাল পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা জেলা (chuadanga) সুলতানী শাসনের অর্ন্তভুক্ত ছিল। পরবর্তীতে শাহ শাসনামল ও হাবশী সুলতানদের শাসনামলে চুয়াডাঙ্গা তাঁদের অধীনে ছিল। ১৫৭৬ সালে দাউদ কররানী মোগল বাহিনীর কাছে পরাজিত ও নিহত হলে বাংলা মোগল শাসনে আসে। ১৬৯৫ সালে মেদেনীপুরের জমিদার শোভা সিংহ এবং জনৈক আফগান সর্দার রহিম খান দক্ষিণ – পশ্চিম বাংলায় মোগল রাজশক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করে। তারা চুয়াডাঙ্গা সহ দক্ষিণ – পশ্চিম বাংলা থেকে মোগল সেনাবাহিনী তাড়াতে সক্ষম হল।
সম্ভবত বন জঙ্গল আকীর্ন চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে বিদ্রোহীদের গোপন আস্তানাও ছিল। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজ – উদ – দৌলা কে পরাজিত করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়। তৎকালীন নদীয়ারাজ কৃষ্ণ চন্দ্র রায় পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ পক্ষকে সমর্থন করেছিলেন। ১৭৬৫ সালে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা রাজস্বের বিনিময়ে কোম্পানী বঙ্গদেশের দেওয়ানী শাসন ক্ষমতা লাভ করেন। ১৭৬৯ সালে জ্যাকভ রেইভার নদীয়ার প্রথম সুপারভাইজার হন। ১৭৮৭ সালের ২১ মার্চ নদীয়া জেলা গঠিত হয়। ইষ্ট – ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে চুয়াডাঙ্গাসহ কুষ্টিয়া অঞ্চল রাজশাহী জেলাভুক্ত ছিল। পরে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার্থে ১৮২৮ সালে পাবনা জেলা গঠিত হলে এ অঞ্চল পাবনা জেলাভুক্ত হয়। ১৮৫৮ সালে রানী ভিক্টোরিয়া ব্রিটিশ ভারতের শাসনাভার নিলে কোম্পানী শাসনের অবসান হয়। ১৮৬০ সালে সুদূর মফঃস্বলে যাতে অত্যাচারী নীলকর বা জমিদার প্রজাদের উৎপীড়ন করতে না পারে সে কারনে নদীয়াকে পাঁচটি মহকুমায় বিভক্ত করা হয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালেই মেহেরপুর মহকুমা, কুষ্টিয়া মহকুমা ও চুয়াডাঙ্গা মহকুমা নিয়ে কুষ্টিয়া জেলার মর্যাদা লাভ করে। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী চুয়াডাঙ্গা জেলায় উন্নীত হয়। চুয়াডাঙ্গা সদর, আলমডাঙ্গা, দামুড়হুদা ও জীবননগর এই চারটি উপজেলা নিয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা গঠিত।
চুয়াডাঙ্গা জেলার ইতিহাস
গ্রীক ঐতিহাসিকদের মতে এ এলাকাতেই বিখ্যাত গঙ্গারিডাই রাজ্য অবস্থিত ছিল। গাঙ্গেয় নামক একটি শহরও এ চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত ছিল বলে শোনা যায়। চুয়াডাঙ্গার নামকরণ সম্পর্কে কথিত আছে যে, এখানকার মল্লিক বংশের আদিপুরুষ চুঙ্গো মল্লিকের নামে এ জায়গার নাম চুয়াডাঙ্গা হয়েছে। ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে চুঙ্গো মল্লিক তার স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ভারতের নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলার সীমানার ইটেবাড়ি- মহারাজপুর গ্রাম থেকে মাথাভাঙ্গা নদীপথে এখানে এসে প্রথম বসতি গড়েন। ১৭৯৭ সালের এক রেকর্ডে এ জায়গার নাম চুঙ্গোডাঙ্গা উল্লেখ রয়েছে। ফারসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার সময় উচ্চারণের বিকৃতির কারণে বর্তমান চুয়াডাঙ্গা নামটা এসেছে। চুয়াডাঙ্গা নামকরণের আরো দুটি সম্ভাব্য কারণ প্রচলিত আছে। চুয়া < চয়া চুয়াডাঙ্গা হয়েছে।। ব্রিটিশ শাসনামলে এ এলাকাটি বেশ কিছু আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল; যেমন: ওয়াহাবী আন্দোলন (১৮৩১), ফরায়েজি আন্দোলন (১৮৩৮-৪৭), সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭), নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-৬০), খেলাফত আন্দোলন (১৯২০), স্বদেশী আন্দোলন (১৯০৬), অসহযোগ আন্দোলন, সত্যাগ্রহ আন্দোলন (১৯২০-৪০), ভারত ছাড় আন্দোলন (১৯৪২) ইত্যাদি। ব্রিটিশ শাসনাধীনে চুয়াডাঙ্গা নদিয়া জেলার একটি উপজেলা ছিল। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় কৃষ্ণনগর থানা (বর্তমানে নদিয়া জেলার অন্তর্গত) বাদে বাকি অংশ কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা
মুক্তিযুদ্ধের সময় চুয়াডাঙ্গা (chuadanga) পাকিস্তান বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সংঘটিত বেশ কিছু প্রাথমিক যুদ্ধের সাক্ষী। এখানে শতাধিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সর্বপ্রথম কমান্ড, দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ড গঠিত হয়েছিল এ জেলায়, মুক্তিযুদ্ধের আট নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল চুয়াডাঙ্গা সদরের ৪নং ইপিআর হেডকোয়ার্টার। ৪নং ইপিআর প্রধান মেজর আবু ওসমান চৌধুরী এবং ডাঃ আসহাব-উল-হক জোয়ার্দ্দারের নেতৃত্বে। একই দিন সকাল ০৯:৩০ এ বড়বাজার মোড়ে ডাঃ আসহাব-উল-হক জোয়ার্দ্দার সর্বপ্রথম দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটিও এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়, এছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাক বিভাগ এবং টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা এই জেলাতেই প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করে । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১০ই এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার চুয়াডাঙ্গাকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করেন। ১৪ই এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাতে মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের কথা ছিলো, কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের কথা জানতে পেরে চুয়াডাঙ্গায় যুদ্ধ বিমান থেকে প্রচুর গোলা বর্ষণ করে। পরে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার বৌদ্দনাথ তলায় বর্তমানে মুজিবনগর এই শপথ অনুষ্ঠান করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর মধ্যে চুয়াডাঙ্গায় একশরও বেশি সম্মুখ যুদ্ধের কথা নথিভুক্ত আছে। নথি অনুসারে ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর তারিখে, অর্থাৎ হানাদার বাহিনী কর্তৃক মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের ৯ দিন আগে, পাকিনস্তানীদের হাত থেকে চুয়াডাঙ্গা মুক্ত হয়।
যুদ্ধকালীন গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতিচিহ্ন রয়েছ- চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের পেছনের স্থানে, নাটুদহ উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে তিনটি গণকবর, জীবননগরে সীমান্তবর্তী ধোপাখালি গ্রামে, এবং আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনের কাছে গঙ্গা-কপোতাক্ষ ক্যানালের তীরবর্তী স্থানে। যুদ্ধের স্মৃতি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে দু’টি স্মৃতি স্তম্ভ।
১৯৮৪ সালে কুষ্টিয়া থেকে পৃথক করে চুয়াডাঙ্গাকে স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা দেয়া হয়।
চুয়াডাঙ্গা জেলার ভৌগোলিক পরিচিতি
অবস্থান ও আয়তন
চুয়াডাঙ্গা (chuadanga) জেলার আয়তন ১১৭০.৮৭ বর্গ কিলোমিটার। চুয়াডাঙ্গা জেলার উত্তর-পূর্বদিকে কুষ্টিয়া জেলা,উত্তর-পশ্চিমে মেহেরপুর
জেলা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে, ঝিনাইদহ জেলা, দক্ষিণে যশোর জেলা, এবং পশ্চিমে ভারতের নদিয়া জেলা অবস্থিত।
জেলার মূল শহর চুয়াডাঙ্গা মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত।
ভূ–প্রকৃতি
চুয়াডাঙ্গা (chuadanga) গাঙ্গেয় অববাহিকায় অন্তর্গত অঞ্চল। প্রায় সমতল থেকে সামান্য বন্ধুর এই প্লাবনভূমি গঙ্গার পানিবাহিত চুনযুক্ত পলিতে গড়া। সম্পূর্ণ এলাকাটি উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্বদিকে ক্রমশ ঢালু। এ অঞ্চলে পদ্মা বারংবার গতি পরিবর্তন করায় এবং চুয়াডাঙ্গার উপর দিয়ে প্রবাহিত পদ্মার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার গতি পরিবর্তন, ভাঙন ও মৃত্যু এ জেলার ভূপ্রকৃতিকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। এ জেলা অতি প্রাচীন নয়, আবার অর্বাচীনও নয়। অনুমান করা যায়, দুই থেকে আড়াই হাজার বছরের মধ্যে এ অঞ্চলের জন্ম। সুতরাং এ জেলাকে পুরাতন চরাঞ্চল বলা যুক্তিসঙ্গত।
জেলার নদীর পাড় এলাকা সচরাচর দোঁআশ থেকে এঁটেল-দোঁআশ ও কিছুটা উঁচু ডাঙ্গা জমি এবং নদীয়া সরাসরি প্রভাবযুক্ত এলাকা অতি মিহি এঁটেল ও নিচু বিল জমি দিয়ে গঠিত। ডাঙ্গা এলাকার দোঁআশ পলির ২/১ মিটার নিচে আবার কোথাও উপর থেকেই বেলে স্তর আছে। পুরানা ডাঙ্গা এলাকর পাশের মজা নদীখাত প্রায়ই এঁটেল পলিতে ভরাট। চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন এলাকর পলির তুলনামূলক বয়সের প্রেক্ষিতে গঙ্গার প্লাবনভূমির প্রধানত দুট বৈশিষ্ট্য দেখা যায়- পুরানা গাঙ্গেয় প্লাবনভূমি ও মিশ্রিত নতুন-পুরানা প্লাবনভূমি।
চুয়াডাঙ্গা জেলার জেলার তথ্যাবলী
প্রশাসনিক এলাকাসমূহ
চুয়াডাঙ্গা শহর চুয়াডাঙ্গা জেলার প্রানকেন্দ্র এবং একটি মধ্যম মানের শহর। চুয়াডাঙ্গা শহরটি মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। এ শহরে ৯ টি ওয়ার্ড এবং ২১১ টি মহল্লা আছে। এটি একটি ‘এ গ্রেড’এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আয়তনের পৌরসভা। পৌরসভা ১৯৭২ সালে ২০শে জানুয়ারী প্রতিষ্ঠিত হয়। শহরের আয়তন ৩৮ বর্গ কিলোমিটার। এর জনসংখ্যা ৪, ১১,৯৭৭; যার মধ্যে পুরুষ ৪৯.৯৯% এবং মহিলা ৫০.০১%। শহরের জনসংখ্যার ১০০% ই শিক্ষিত।
চুয়াডাঙ্গা জেলার অভ্যন্তরীণ মানচিত্র
চুয়াডাঙ্গা (chuadanga) জেলায় মোট ৪টি উপজেলা রয়েছে। উপজেলাগুলো হল:
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা :
ইউনিয়ন (৭টি): আলুকদিয়া, মোমিনপুর, কুতুবপুর, শংকরচন্দ্র, পদ্মবিলা, তিতুদহ,এবং মাখালডাঙ্গা
আলমডাঙ্গা উপজেলা
ইউনিয়ন (১৫টি): ভাংবাড়িয়া, হারদী, কুমারী, বাড়াদী, গাংনী, খাদিমপুর, জেহালা, বেলগাছি, ডাউকী, জামজামী, নাগদাহ, খাসকররা, কালিদাসপুর, চিৎলা এবং আইলহাঁস
জীবননগর উপজেলা
ইউনিয়ন (৮টি): উথলী, আন্দুলবাড়িয়া, সীমান্ত, বাঁকা, হাসাদাহ, রায়পুর, মনোহর এবং কেডিকে
দামুড়হুদা উপজেলা
ইউনিয়ন (৮টি): জুড়ানপুর, ননিপোতা, কার্পাসডাঙ্গা, হাউলী, দামুড়হুদা এবং নাটুদহ,কুড়ুলগাছি, পারকৃষ্ণপুর মদনা
চুয়াডাঙ্গা জেলার জনসংখ্যা
২০১৮ সালের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদন মতে চুয়াডাঙ্গা জেলার বর্তমান জনসংখ্যা ২৫ লক্ষ প্রায়।
চুয়াডাঙ্গা জেলার ঐতিহ্য
লোকসঙ্গীত ও ঐতিহ্য
অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলা ছিল বাঙালী সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। পৌরবময় সেই উত্তরাধিকার চুয়াডাঙ্গা (chuadanga) জেলাও বহন করে চলেছে। এখানকার লোকসংস্কৃতি ও গ্রামীণ ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। এক সময় মুর্শিদী, মারফতি, যাত্রা, ভাসান, কবিগান, কীর্তন, জারি গান, গাজারী গীত, গাজনের গান, মাদার পীরের গান, মেয়েলী গীত, বিয়ের গান, কৃষকের মেঠোগান, প্রভৃতি গ্রামগুলো মুখরিত করে রাখত।
এ জেলা মুসলমান ফকির ও বাউলপন্থী হিন্দু বৈষ্ণব প্রমুখের ধর্ম সাধনার একটি কেন্দ্রস্থল। লালনের বহুসংখ্যক অনুসারী ও গোসাই গোপাল ও অপরাপর অনেক বাউলপন্থী রসিক বৈষ্ণবের বাস ও বিচরণ স্থান এই চুয়াডাঙ্গা।
জারিগান
জারিগান বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি বিশিষ্ট সম্পদ। বাউল গানের পাশাপাশি এ অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে জারিগান বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। মহররমের চাঁদ দেখার রাত থেকে জারিগান ও জারিনৃত্য শুরু হয়।১০ মহররম পর্যন্ত ১০ দিন ধরে এই গান অনুষ্ঠিত হয।
চুয়াডাঙ্গা (chuadanga) অঞ্চলে জারিগানের কুশলী শিল্পী হিসেবে আহাদ গায়েন (কুলচারা), শুকুর আলী (হানুরবাড়াদি), আজিবার রহমান (সুমিরদিয়া), সুলতান আলী ও ফলেহার (হাজরাহাটি), মাতু গায়েন (হোগলবগাদি), হায়দার আলী (জাফরপুর), হোসেন গায়েন (নাগদহ), মোহর আলী, নবীন মন্ডল প্রমুখের অবদান রয়েছে।
ভাসানগান
চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে শ্রাবণ মাসে অর্থাৎ বর্ষা ঋতুর প্রায় মাঝামাঝি সময়ে এই ভাসানযাত্রার প্রচলন রয়েছে। বর্ষাকালেই এদেশে সাপের কামড়ে লোকের মৃত্যু হয় বেশি। বাংলার লৌকিক কাহিনী চাঁদ সদাগর এবং তার পুত্রবধু বেহুলা, পুত্র লখীন্দর ও মনসার কাহিনীকে অবলম্বন করে ভাসানযাত্রা রচিত।
ভাসানযাত্রার ওলিয়ার রহমান মালিতা, তকিম মন্ডল, কিয়ামুদ্দিন (জাফরপুর), হাজারী (দৌলতদিয়াড়) সৈয়দ আলী (পীরপুর), আফসার আলী, বাহার আলী, মাদব, ভাদু, কায়েম আলী, মনসুর চাঁদ, তাহার আলী (চুয়াডাঙ্গা) প্রমুখ অবদান রয়েছে।
ঝাপন ও মনসার গান
শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি ঝাপান অনুষ্ঠিত হয়। সাপসহ সাপুড়েরা অন্যান্য সাপুড়েদের সাথে প্রতিযোগিতামূলক ঝাপানে অংশ নিয়ে থাকে। চুয়াডাঙ্গা জেলার কেদারগঞ্জের প্রেমচাঁদের গলায় সেই চির পুরাতন অথচ চির নবীন বেহুলা লখীন্দরের খাত
এই না শাওন মাসে ঘনবৃষ্টি পড়ে,
কেমন করে থাকবো বলো আমি
অন্ধকার ঘরে।
যাত্রা
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির সমৃদ্ধ ভান্ডারে যাত্রা এক অমূল্য সম্পদ। ঐতিহ্যমন্ডিত কোন লোকবিষয়ক নাট্যরূপ দিয়ে তার যে গীতাভিনয় প্রদর্শন করা হয় তাকেই যাত্রা বলা হয়। চুয়াডাঙ্গাতে বেশ কয়েকটি যাত্রা দল আছে যেমন- শক্তিমিলন অপেরা (চুয়াডাঙ্গা), রংমহল অপেরা (জামজামি), সরোজগঞ্জ যাত্রা ইউনিট (তিতুদহ), পল্লীশ্রী অপেরা (আসমানখালী), হিরোবয়েজ যাত্রা গোষ্ঠী (লক্ষ্মীপুর), গাড়াবাড়িয়া যাত্রা ইউনিট ইত্যাদি যথেষ্ট যশ ও খ্যাতি লাভ করেছিল।
কবিগান
কবিগান চুয়াডাঙ্গা (chuadanga) জেলার অন্যতম জনপ্রিয় গান। আগে শীতকালব্যাপী কবিগানের লড়াই হতো। অনেক সময় ৬/৭ দিন ধরেও প্রতিযোগিতামূলকভাবে এই গান চলতো। কাতর বয়াতি (চুয়াডাঙ্গা), আব্দুর রাজ্জাক (এনায়েতপুর, বাড়াদি), হোসেন গায়েন (নাগদাহ), মাহতাব গায়েন (ভোগাইলবগাদি), আহাদ গায়েন (কুলচারা), সারোয়ার গায়েন (খাদিমপুর) প্রমুখ কবিয়াল হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন।
গাজীর গান
লৌকিক আচারসহ গাজীর গান পরিবেশিত হতো। গাজী পীরের বন্দনা ও মাহাত্ম্য প্রচারই গাজীর গানের উদ্দেশ্যে। সন্তান লাভ, রোগ-ব্যধির উপসম, অধিক ফসল উৎপাদন, গরু-বাছুর ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি এরুপ মনস্কামনা পুরণার্থে গাজীর গানের পালা দেওয়া হতো।
গাজনের গান
লোক উৎসবমূলক গাজনের গান চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের নিম্নবর্ণের হিন্দু সমাজে প্রচলিত ছিল। এখানো চৈত্র সংক্রান্তিতে তিনদিনব্যাপী গাজন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
মেয়েলী গীত
চুয়াডাঙ্গা (chuadanga) মেয়েলী গীত বেশ সমৃদ্ধ। যেকোন পারিবারিক ও সামাজিক আমোদ উৎসবে বা আচার-অনুষ্ঠানে গ্রামের মেয়েরা একক বা দলবদ্ধভাবে এ গান পরিবেশন করে থাকে।
এছাড়াও লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রে চুয়াডাঙ্গা এলাকায় যেসব শিল্পী কুশলীরা বিভিন্ন সময় অবদান রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে দৌলতদিযাড়ের হাজারী বাদল, নতিডাঙ্গার দিদার বকস, খাদেমপুরের সাবের গায়েন, মোজাম্মেল ও দিদার বকস প্রমুখ।
শব্দগান এর শিল্পীদের মধ্যে জাহাপুরের খোদা বকস শাহ ও ইউনুস আলী, ভুলটিয়ার খোরশেদ শাহ, তাইজেল ও আফজাল শাহ, বহালগাছির হেদায়েত শাহ, দর্শনার হোসেন শাহ, ফরিদপুর (আলমডাঙ্গা) এর বেহাল শাহ ও দুলাল শাহ প্রমূখ।
চুয়াডাঙ্গা জেলার লোকজ উৎসব
চুয়াডাঙ্গা (chuadanga) অঞ্চলের কৃষক সমাজে আনন্দঘন পরিবেশে নানারকম উৎসব পালিত হতো। বিশেষ করে বীজ বোনা ও ফসল কাটা কাজ শেষ হলে সম্পন্ন কৃষকের ঘরে আনন্দ উৎসবের আয়োজন ছিল অতীতের সাধারণ ঘটনা। নানারকম নাচ-গান আনন্দস্ফুর্তির মধ্যে দিয়ে পল্লী পরিবেশকে আনন্দমুখর করে তোলা হতো।
গাস্বি উৎসব
আশ্বিন মাসের শেষ রাত থেকে এ অনুষ্ঠানের শুরু, শেষ হয় পয়লা কার্তিকের সকালে। ফসল যাতে ভালো হয়, সে উদ্দেশ্যে হয় এই উৎসব। জনশ্রুতি আছে;
আশ্বিনে রাঁধে বাড়ে,
কার্তিকে খায়,
যে যেই বর মাগে
সেই বর পায়
নবান্ন
নতুন ফসল ঘরে উঠলে অগ্রহায়ণ মাসে ধুমধামের সাথে চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে নবান্ন উৎসব পালিত হয়। ঢেঁকিতে নতুন চাল কুটে, পিঠে পুলি, নারকোলের নাড়ু বানিয়ে পাড়া প্রতিবেশি আত্মীয় স্বজনের সাথে খাওয়া দাওয়া হতো।
বৃষ্টি আবাহন
যথাসময়ে বৃষ্টি না হলে কৃষিকাজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে বিপর্যয় দেখা দেয়। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য চুয়াডাঙ্গা এলাকায় ব্যাঙ বিয়ে, বদনা বিয়ে ইত্যাদি অনুষ্ঠান হয়।
হালখাতা
হালখাতা প্রধানত ব্যবসায়ীদের উৎসব। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে চুয়াডাঙ্গা এলাকার ব্যবসায়ীরা হিসাবের নতুন খাতা খোলে এবং তাদের ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করে।
পয়লা বৈশাখ
বৈশাখের প্রথম দিন আলু ভর্তা, ডালভর্তা, মাছভাজা দিয়ে পান্তাভাত খাওয়ার রেওয়াজ দেখা যায়। এই দিন সবাই সাধ্যমতো ভাল খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করে । এতে এই বিশ্বাস কাজ করে যে, বছরের প্রথম দিন ভালো খাওয়া দাওয়া হলে সারা বছরই ভালো খাওয়া হবে।
মেলা
পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে ডিঙ্গেদহসহ চুয়াডাঙ্গা গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজারে প্রায় অর্ধশতাধিক মেলা বসে। এসব মেলায় বিভিন্ন রকম জিনিসপত্র নানারকম খেলনা আর প্রচুর মিষ্টান্ন বিক্রি হয় এবং প্রচন্ড লোক সমাগম ঘটে। এছাড়া ১লা আষাঢ় থেকে ৭ দিন গড়াইটুপির মেটেরি মেলা, বারুনী এবং গঙ্গাপুজা উপলক্ষে নানা জায়গায় জমজমাট মেলা বসে। গড়াইটুপি মেলায় বাংলাদেশের বহু জেলার লোক মেলায় আগমন ঘটে।
পুতুল নাচ
চুয়াডাঙ্গা (chuadanga) জেলায় এক সমযে পুতুল নাচ জনপ্রিয় ছিল। আন্দুলবাড়িয়া ও মুর্তজাপুর অঞ্চলে কয়েকটি পুতুল নাচের দল ছিল। এরা মাটি, কাঠ ও কাপড় দিয়ে তৈরী পুতুল নাচিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। পর্দার আড়ালে সুতোর সাহায্যে পুতুলকে নাচানো হতো। পৌরাণিক কাহিনী ছিল এ নাচের বিষয়।
হিজড়া নাচ
চুয়াডাঙ্গার হিজড়া সম্প্রদায় তাদের জীবিকার পন্থা হিসেবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নবজাত শিশুকে কোলে নিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নাচ গান বাজনা পরিবেশন করে টাকা-পয়সা, চাল আদায় করে থাকে।
চুয়াডাঙ্গা জেলার ভাষা ও সংস্কৃতি
আঞ্চলিক ভাষা
ভাষা ভাব প্রকাশের মাধ্যম। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল বা ভূ-খন্ডে বসবাসরত মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আবার স্থানীয় রীতি-নীতি, আচার-আচরণ ও পরিবেশগত কারণে এলাকাভেদে একই ভাষায় ব্যবহৃত ও প্রচলিত শব্দ, শব্দের অর্থ ও উচ্চারণগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বাংলা ভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাভাষী জনগণের অঞ্চলভেদে বাকভঙ্গির কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কোন ভাষাকে আশ্রয় করে সীমিত পরিসরে ব্যবহৃত শব্দ বা বাক্যসমূহই আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে চিহ্নিত।
ভাষাতাত্ত্বিকগণের কাছে আঞ্চলিক ভাষার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন:
ভাষাতত্ত্বের অনেক জটিল সমস্যার সমাধান আঞ্চলিক ভাষার সাহায্যে হতে পারে।
আঞ্চলিক ভাষাকে ভিত্তি করে রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা সাহিত্যিক প্রভাবে সাহিত্যের ভাষা গড়ে ওঠে। আঞ্চলিক ভাষাগুলোর মধ্যেই সাহিত্যিক ভাষার ইতিহাস বজায় থাকে।
ভাষাকে প্রাচীর দিয়ে সীমায়িত করা যায় না। এক জায়গায় ভাষা অনায়াসে অন্য জায়গার ভাষাকে প্রভাবিত করে। চুয়াডাঙ্গা এলাকার সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় রয়েছে উচ্চারণ সচেতনতা ও শব্দ প্রয়োগে ঔচিত্যবোধ। সেজন্য এ ভাষা প্রসাদগুণ সম্পন্ন ও সুষমামিন্ডিত। এ অঞ্চলের মুখের ভাষার গতি সাবলীল ও বিশিষ্ট বাগভঙ্গী খুবই জীবন্ত ও হৃদয়গ্রাহী।
গত কয়েক শতাব্দী ধরে ভাগীরথী নদীর উভয় তীবরর্তী অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার ধ্বনি, রুপমূল, উচ্চারণ ও ব্যাকরগত কাঠামোর সৌসাম্য সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের উপর প্রভাব বিস্তার করে আসছে। এ অঞ্চলের ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত কথ্য ভাষার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা চলিত ভাষা সমগ্র বাঙালি জাতির মৌখিক ভাষা হিসেবে মান্যতার সঙ্গে অনুসৃত হচ্ছে।
লোকসংস্কৃতির বাহন হচ্ছে লোকায়ত ভাষা। এ এলাকায় প্রচলিত ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন, ছড়া, মেয়েলী গীত, লোককাহিনী, বিংবদন্তী, লোকগাথা ও গীতিকার লালিত্যমন্ডিত বর্ণময় প্রকাশ সেই ভাষাতেই বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, চুয়াডাঙ্গা এলাকার গৌরবান্বিত এ উপভাষা চুয়াডাঙ্গা জেলার শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
চুয়ডাঙ্গা (chuadanga) জেলঅর উপভাষা বিশিষ্টতা অর্জন করেছে তার ভৌগোলিক অবস্থানের ভাষাবিজ্ঞানী জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন , ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুকুমার সেন প্রমুখ পন্ডিতগণ মধ্যপূর্ব রাঢ়ী উপভাষার যে সীমানা নির্ধারণ করেছেন চুয়াডাঙ্গা জেলা তার মধ্যে পড়ে।
চুয়াডাঙ্গা জেলার মানুষ মোটামুটি শুদ্ধ বাংলা বাষায় কথা বলেন। এখানকার আঞ্চলিক বাষা তাই বাংলা ভাষারই অংশবিশেষ। তথাপি চুয়াডাঙ্গার কথ্য ভাষায় বাক্য ও উচ্চারণগত এমন কিছঝু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্যত্র দেখা যায় না। এখানে এমন কিছু শব্দ শোনা যায়, যা বাংলাভাষী আর কোন জায়গাতেই প্রচলিত নয়। এসব শব্দ ও কাব্য-সম্ভারই চুয়াডাঙ্গার আঞ্চলিক ভাষা, যা যুগ-যুগ ধরে এখানকার কথ্যভাষাকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে।
চুয়াডাঙ্গার (chuadanga) আঞ্চলিক ভাষার বেশকিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। সেগুলো হলো: ও-কার এর বদলে উ-কার হয়ে যায়। যেমন: ঘোড়া/ঘুড়া, বোবা/বুবা, খোকা/খুকা, অতিরিক্ত সংযোজন লক্ষণীয়। যেমন: চাল/চাইল, ডাল/ডাইল, মূলা/মূইলো, কাঁচি/কাইচে ইত্যাদি। দ্রুত উচ্চারণের অক্ষর লোপ পায়। যেমন: করছিস/কচ্ছিস, মারছে/মাচ্ছে ইত্যাদি। চ অনেক ক্ষেত্রে ড হয়ে যায়। যেমন: ছেলেটা/ছেলেডা, ডালটা/ডালডা ইত্যাদি।
দ কে গ বলার প্রবণতা রয়েছে। যেমন: আমাদের/আমাগের, তাদের/তাগের, ইত্রঅদি। র কে অ উচ্চারণ লক্ষনীয়। যেমন: রাত/আত, রক্ত/অক্ত ইত্যাদি। দ্রুত উচ্চারণে ত লোপ পায়। যেমন: ভাত/ভা (মা ভা দাও)। ন উচ্চারিত হয় ল রুপে। যেমন: নিয়ে/লিয়ে, নড়াচড়া/লড়াচড়া ইত্যাদি।
এখানে আঞ্চলিক বাক্যের কিছু উদাহরণ ছাপা দেওয়া হলো:
বুকা (বোকা)-তুমার মত অগা মার্কা লোক তো দেকিনি। অপ্চো (অপচয়/বিনষ্ট)- এ্যাতো অপ্চো কি তার সৈজ্জ্য হয়! আশোইলে (জ্বালাতন)- একুন যা তো, আশোইলে করিস্নে। আস্পদ্দা (স্পর্ধা)- ছেইলেটার আস্পদ্দ তো কম না! আচাতিমি (অকারণ)-আচামিতি কি কেউ কারো গা’য় হাতে তোলে? আচিঘর (আতুরঘর)- খালেদা আচিঘর’তি (থেকে) একুনু বেরোয়নি। আগ্লা (খোলামেলা)- তাল্ডা আগ্লা রাকিছিস্, তাই মাছি বস্চে। আন্কুরা (নতুন)- আন্কুরা তবোন্ডা (লুঙ্গি) হারি’ফেলি? ইজের (পায়জামা)- নোতোন্ ইজেরডা ছিইড়ে গ্যালো।
ইবা, (এবার)- ইবার অসুক হোলি আর বাইচপো না। ইন্দুর (ইঁদুর)- ধানে খুব ইন্দুর লাইগোচ্ গো। উইদমো (বোকা প্রকৃতি)- উইদমো লোকের তালে পলাম দেক্চি। উমা (আশ্চর্যবোধক উচ্ছাস)- উমা!কী সুন্দর শাড়ি। ওমিন্দি (ঐদিক দিয়ে)-তোরে বুলাম ওমিন্দি যা, তুই গেলিনে।
কোইদমে (মিষ্টিকুমড়া)- কোইদমের ফলন গতবারই ভালো হোয়েলো। কোইতোর (কবুতর)- ওলির লাল কইতোরডা মইরে গিয়েচে। কের্মে কের্মে (ক্রমে ক্রমে)- জ্বরডা (জ্বরটা) কের্মে কের্মে বাইড়িই যাচ্চে। কুক্ড়ো (মুরগী)- কুকড়োগুইন খ্যাদ্যা শিগ্গির (মুরগীগুলো তাড়া শিগ্গির)। কুষ্টা (পাট)- বাজারে কুষ্টার দাম পোইড়ে গিয়েচে।
খাইদে (ময়লা/আবর্জনা)- খাইদেডা পরিস্কার কোলিনে? খ্যাতা (কাঁথা)- গত শতি খ্যাতার খুব কষ্ট হোয়েচে রে। খর (খয়ের)- বাজারতি দু’ট্যাকার খর্ আইনো (বাজার থেকে দুই টাকার খয়ের এনো)। খুশাম্দি/খুশান্দি/খুশামোদ (তোষামোদ)- ইস্কুলি যাওয়ার জন্নি উর্ ককুন্তি খুশান্দি কচ্চি ( স্কুলে যাওয়ার জন্য ওকে কখন থেকে তোষামোদ করছি)।
গেইড়ো (গেড়ো/আঞ্জলি)- গেইড়ো পাত শীগ্গীর, মুড়কি নে। গবোর (গোবর)- গবোর সারই ফসলে জন্নি ভালো। গিরাম/গৈগিরাম(পাড়াগাঁ)- গৈগিরামে একুন খুব অভাব। গোবিন (অন্তঃসত্বা; ছাগল-গরুর ক্ষেত্রে)-আহাগো জয়নালের গোবিন গরুডা (গরুটা) সাপে কাম্ড়ি মইরে গ্যালো! গড়ান্ (ঢালু)- রাস্তাডা এ্যাকেবারিই গড়ান্ হোয়েচে।
ঘষি/ঘুটা (গোবরে তৈরি জ্বালানি বিশেষ)- বৃষ্টির পানিতে ঘষিগুইন্ ভিইজে গ্যালো, শীগ্গীর তোল। ঘুন্নি (ঘুড়ি)-ঈদির আগে আকাশে অনেক ঘুন্নি ওড়ে। ঘ্যানা (বোকা/নির্জীব প্রকৃতির)- এ্যাতো ঘ্যানা লোক নিয়ে তো পারা যায় না দেক্চি।
চিরোন্ (চিরুনী)- চিরোন্ডা সেই যে হারাইলো, আইজও কিনার মুরোদ হলো আ। চাইলে পানি (চাল ধোয়া পানি)- চাইলে পানিডা গরুর নাইন্দে দি’দিস (চাল ধোয়া পানিটা গরুর নাদায় দিয়ে দেসি)। চশোমখোর (নির্লজ্জ)- চশোমখোরের মোতো কাজডা কি না কোলিই হৈতো না?
ছ্যান্ (গোসল)-ছ্যান্ডা কোইরে নিয়াই জানো ভালো ছিল (গোসলটা করে নেওয়াই যেন ভাল ছিল)। ছেউই (সেমাই)- ছেউই রান্দাডা আইজ্ এট্টু ভালো লাগিনি। ছাপড়ো (নিচু)- ঘর্ডা খু্বই ছাপ্ড়ো হৈলো।
সংস্কৃতি
অতি প্রাচীনকাল হতেই চুয়াডাঙ্গা (chuadanga) অঞ্চল বাঙালী সংস্কৃতির সকল ঐতিহ্য লালন পালন করে আসছে। দেশের লোকসাহিত্য ও লোকসংগীতে এ জেলার একটি বিশেষ অবস্থান রয়েছে।বিশেষ করে এ জেলার সমৃদ্ধ বাউল সংগীতের খ্যতি দেশ ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে রয়েছে। প্রখ্যাত লালন সাধক খোদা বকশ সাঁই এর জন্মস্থান এ জেলার জাঁহাপুর গ্রামে, যিনি লোকসংগীতে তাঁর বিশেষ অবদানের জন্য একুশে পদকে ভূষিত হয়েছিলেন।বাউল ছাড়াও যাত্রাগান, জারিগান, কবি গান, বিয়ে উপলক্ষে মেয়েলি গান, পুতুল নাচ, ঝাপান গান (সাপের খেলা) এ জেলার সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে।
এ জেলায় বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। যার মধ্যে ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী গড়াইটুপিঅমরাবতী মেলা অন্যতম। প্রতি বছর আষাঢ়ের ৭ তারিখ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত এইঐতিহাসিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়াও সরিষাডাঙ্গার বিশুশাহ বাউল মেলা, খোদা বকশ সাঁই-এরমৃত্যুদিবস উপলক্ষে জাহাপুরে দু্ই দিনের বাউল মেলা অন্যতম।এ ছাড়াও প্রতি বছর ১লা বৈশাখে জেলা শিল্পকলা একাডেমী চত্বরে বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
এ জেলার মানুষ ঐতিহ্যগত ভাবে সংস্কৃতিমনা বলেই এখানে গড়ে উঠেছে অনেক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও নাট্য ক্লাব। ১৯৫০ সালে চুয়াডাঙ্গায় ডাঃ মনোরঞ্জন ব্যানার্জির উদ্যোগে প্রথম সংগীত প্রতিষ্ঠান “চুয়াডাঙ্গা সংগীত সংঘ”প্রতিষ্ঠিত হয়।১৯৭৭ সালে “চুয়াডাঙ্গা (chuadanga) মহকুমা শিল্পকলা পরিষদ”নামে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর স্থানীয় শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় যা পরবর্তীতে শিল্পকলা একাডেমীর মর্যাদা লাভ করে।এছাড়াও অরিন্দম সাংস্কৃতিক সংগঠন, সংলাপ সাংস্কৃতিকগোষ্ঠী, চুয়াডাঙ্গা থিয়েটার,অনির্বান থিয়েটার, সাম্প্রতিক থিয়েটার, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, সরগম শিল্পি গোষ্ঠী, আলমডাঙ্গা কলা কেন্দ্র, আলমডাঙ্গা শিল্পকলা একাডেমী, নাগরিক নাট্য দল,স্বদেশ শিল্পি গোষ্ঠী, মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, দোলনচাপাঁ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, হিন্দোল, ভৈরবী, ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম, লালন একাডেমী ইত্যাদি অনেক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সংস্কৃতি অঙ্গনে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে।
এ জেলার মানুষের বিনোদনের জন্য গড়ে উঠেছে বেশ কিছু সিনেমা হল। যার মধ্যে রুপছায়া সিনেমা, নান্টুরাজ সিনেমা, আলমডাঙ্গার আলমডাঙ্গাটকীজ, শিলা সিনেমা, দর্শনার হীরা সিনেমা, জীবননগরের মহানগর ও আধুনিক সিনেমা অন্যতম।
এ ছাড়াও এ জেলায় শিশুদের বিনোদনের জন্য গড়ে উঠেছে শিশু স্বর্গ ও পুলিশ পার্ক।
চুয়াডাঙ্গা জেলার ব্যবসা–বাণিজ্য ও শিল্প
ব্যবসা ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিভাগ পূর্বকাল থেকেই চুয়াডাঙ্গা (chuadanga) যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। কলকাতা সন্নিকটে হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার ঘটে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে তাঁতের কাপড়, নীল, গুড়, নৌকা ও পিতলের বাসন-কোসন তৈরির জন্য চুয়াডাঙ্গা অঞ্চল বিখ্যাত ছিল। যদিও ব্রিটিশ বাণিজ্য নীতির প্রতিকূলতার ফলে এইসব শিল্পের অনেকগুলো বিশেষত বস্ত্র ব্যবসা আস্তে আস্তে ধ্বংস হতে থাকে।
চুয়াডাঙ্গা (chuadanga) জেলার ভারি শিল্প বলতে কেরু এ্যান্ড কোম্পানির শিল্প কমপ্লেক্সকেই বোঝায়। ১৯৩৮ সালে পূর্ব-বাংলার আখ সমৃদ্ধ এলাকা দর্শনায় রবাট রাসেল কেরু দৈনিক ১০০০ টন আখ মাড়াই ও ৪০০০ এল.পি.জি স্পিরিট তৈরির ক্ষমতা সম্বলিত এই চিনিকল ও ডিস্টিলারিটি স্থাপন করেন। তখন শুধু যন্ত্রপাতি কিনতেই খরচ হয়েছিল ৩৪ লাখ টাকা । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর এটি জাতীয়করণ করে কেরু এ্যান্ড কোং (বাংলাদেশ) লিঃ নামে অভিহিত করা হয় । বর্তমানে এটি বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থার একটি প্রতিষ্ঠান এবং এর অধীনে রয়েছে চারটি প্রতিষ্ঠান- চিনিকল, চোলাই (ডিস্ট্রিলারি), ঔষধ কারখানা ও একটি কৃষি খামার।
চুয়াডাঙ্গার (chuadanga) আলমডাঙ্গা, দর্শনা প্রভৃতি স্থান অতীতকাল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। তন্মধ্যে পাটের আড়তের জন্য আলমডাঙ্গা, ডাল ব্যবসার আড়তদারী বাজারের জন্য আলমডাঙ্গা ও মুন্সীগঞ্জ এবং সর্বোপরি কাপড়ের আড়তদারী ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে চুয়াডাঙ্গা ও আলমডাঙ্গা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আলমডাঙ্গা তাঁত শিল্পের প্রধান কেন্দ্রগুলির অন্যতম। এসব এলাকার তৈরি কাপড়ের ধুতি, শাড়ী, গামছা, লুঙ্গি, তোয়ালে ও বিছানার চাদর উল্লেখযোগ্য। এসব কাপড় বিক্রির জন্য এখানে একটি বড় বাজার আছে। হাজার হাজার পরিবার এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এখানকার তাঁতিরা যথেষ্ট দক্ষ। উন্নতমানের শাড়ী, লুঙ্গি তৈরিতে এদের সুনাম আছে। বর্তমানে চুয়াডাঙ্গায় স্থাপিত তাল্লু ন্পিনিং মিলস বিশেষভাবে পরিচিত।
আধুনিককালে চুয়াডাঙ্গা জেলার ব্যবসা-বাণিজ্য আগের তুলনায় সম্প্রসারিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেশ কিছু মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান। কৃষিও শিল্পে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এবং সেই সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতর হওয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটেছে। তবে লক্ষণীয় এই যে, আগের মতো কৃষিপণ্যই ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান উপকরণ। ফলে শিল্পজাত ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও এবং শহর অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত আধুনিক বিপণী ব্যবস্থা চালু চেষ্টা থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের সিংহভাগই কৃষিজাত ভোগ্যপণ্যের উপর নির্ভরশীল।বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৪টি মাঝারি শিল্প ৭৪৬টি ক্ষুদ্র শিল্প এবং ৪ হাজার ৮৬২ টি কুটির শিল্প রয়েছে।
সম্প্রতিকালে চুয়াডাঙ্গা (chuadanga) জেলায় ক্ষুদ্র শিল্পের যথেষ্ট সম্প্রসারণ ঘটেছে। এখানে অসংখ্য ধান থেকে চাল তৈরির মিল গড়ে উঠেছে। রয়েছে বেশ কিছু স-মিল। ছোট আকারে কিছু বিড়ি শিল্পও লক্ষ্য করা যায়। বেকারি শিল্প রয়েছে বেশ কয়েকটি। চুয়াডাঙ্গার বঙ্গজ বিস্কুট ফ্যাক্টরি সারাদেশে বিশেষভাবে পরিচিত।
চুয়াডাঙ্গার ব্যবসা বাণিজ্য বলতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের আড়ৎদারিকেই বোঝায়। চুয়াডাঙ্গা জেলা পানের জন্য সারাদেশে পরিচিত। এ জেলায় উৎপাদিত পান প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলায় ও বিদেশে রপ্তানি করা হয়। চুয়াডাঙ্গা জেলার খেজুরের গুড় সারাদেশে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। এ জেলায় প্রচুর খেজুর গাছ জন্মে। এ অঞ্চলের খেজুর গাছের রস খুব মিষ্টি ও সুস্বাদু। এর আহরিত রস দ্বারা উৎপাদিত গুড় সুদুর অতীত থেকে এখন পর্যন্ত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেশে ও বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
ইদানিং চুয়াডাঙ্গা জেলায় পোলট্রি শিল্প বেশ বিস্তার লাভ করেছে। এদের মধ্যে রাফিদ পোলট্রি এন্ড হ্যাচারী লিঃ অন্যতম। যারউৎপাদিত পণ্য দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানী হচ্ছে। এ ছাড়াও এজেলায় ব্যক্তি উদ্যোগে অনেক পোলট্রি খামার গড়ে উঠেছে।
এ জেলার সীমান্ত দর্শনায় চেকপোস্ট থাকায় সেখানে বেশ কিছু ক্লিয়ারিং-ফরওয়াডিং ব্যবসার অফিসও গড়ে উঠেছে। ফলে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার প্রসার লাভ করেছে এবং অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে। এবং বর্তমানে এ জেলায় প্রস্তাবিত আরেকটি স্থলবন্দর স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন।
চুয়াডাঙ্গা জেলার কৃষি
চুয়াডাঙ্গা (chuadanga) বাংলাদেশের মধ্যে ভুট্টা,পান,শাকসবজি, খেজুরের গুড় উৎপাদনে প্রথম স্থান অর্জন কারী জেলা । এ ছাড়া বাণিজ্যিক ফুল এবং আম উৎপাদনে বাংলাদেশের জেলাসমূহের মধ্যে দ্বিতীয়। এই জেলার বেশিরভাগ মানুষ কৃষিকাজে নিয়োজিত। শ্রমশক্তির ৫৮% কৃষিকাজে, এবং মাত্র ২২% ব্যবসা বাণিজ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট। আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৯৪.২০ বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে ৯৯% কোন না কোন প্রকার সেচ ব্যবস্থার আওতাধীন।
ব্যবহৃত ভূমির মধ্যে আবাদী জমি ৮৯৪.২ বর্গকিলোমিটার; অনাবাদী জমি ২.৫৪ বর্গকিলোমিটার; দুই নফসলী জমি ১৪.৮৫%; তিন ফসলী জমি ৭৩.৮৫%; চার ফসলী জমি ১১.৮০%; সেচের আওতাভুক্ত আবাদী জমি ৯৯%। ভূমিস্বত্বের ভিত্তিতে ৩৭% ভূমিহীন, ৪৩% নিম্ন বর্গীয়, ১৮% মধ্যম এবং ২% ধনী; মাথাপিছু আবাদী জমির পরিমাণ ১,১০০ বর্গমিটার। প্রতি ১০০ বর্গমিটার মানসম্মত জমির বাজারমূল্য আনুমানিক ১,০০,০০০ টাকা।
প্রধান শস্য ধান, ভুট্টা, পান,পাট,গম, আলু, আখ, তামাক,বেগুন, পেঁয়াজ, রসুন, ডাল,বাঁধা কপি,পাতা কপি,মুলা,গাজর,ধনে পাতা,ঢেরশ,বরবটি, শিম, কুমরা, বিভিন্ন ধরনের ফুল এবং বিভিন্ন প্রকার শাক সবজি । বিলুপ্ত বা প্রায়-বিলুপ্ত শস্যের মধ্যে আছে তিল, তিসি, সরিষা, ছোলা, আউশ ধান এবং নীল।
প্রধান ফল আম, কাঁঠাল, লিচু, পেঁপেঁ, পেয়ারা, কুল,পান, নারিকেল এবং কলা।
জেলায় রয়েছে অসংখ্য মুরগির খামার, মাছের খামার, গরুর খামার ও বড় বড় মুরগি,হাঁস ও মাছের হ্যাচারি। জীবননগরে অবস্থিত দত্তনগর ফার্মটি এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম কৃষিখামার হিসেবে পরিচিত।
চুয়াডাঙ্গা জেলার অর্থনীতি
জেলার পেশার মধ্যে রয়েছে কৃষি ৩০.৩৩%, কৃষিশ্রমিক ১৮.০৮%, দিন মজুর ২.৬৯%,ব্যবসা ২২.৯৭% চাকরি ১৩.০৮%, পরিবহন খাত ৪.৯১% এবং অন্যান্য ৮.২২%।
উৎপাদনশীল কলকারখানার মধ্যে রয়েছ তুলার কল, চিনি কল, বিস্কুট কারখানা, স্পিনিং মিল, টেক্সটাইল মিল, এ্যালুমিনিয়াম কারখানা, ওষুধ তৈরির কারখানা, চালকল, চিরার কল, তেল কল, আটা কল, বরফ কল, করাত কল এবং ওয়েল্ডিং কারখানা। কুটির শিল্পের মধ্যে রয়েছে বয়নশিল্প, বাঁশের কাজ, স্বর্ণকার, কর্মকার, কুম্ভকার, ছূতার, তন্তুবায়, দরজি ইত্যাদি।
কৃষির পাশাপাশি জেলাটিতে বর্তমানে শিল্পেরও বিকাশ ঘটছে। প্রধান শিল্প কারখানা গুলো হল “জামান গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ:- হ্যাচারী,ফিড মিল,ব্যাভারেজ লিমিটেড,প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি,ফ্রিজ ফ্যাক্টরী,এসি ফ্যাক্টরী, টিভি ফ্যাক্টরী,সিলিং ফ্যান ফ্যাক্টরী, স্টীল ফ্যাক্টরী,” স্যার ফ্যাক্টরী, ইলেকট্রনিক্স ফ্যাক্টরী, তামাক ফ্যাক্টরী, বিস্কুট ফ্যাক্টরী, বঙ্গজ ব্রেড এন্ড বিস্কুট, তাল্লু স্পিনিং মিল্স লিমিটেড, কেরু এন্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড ইত্যাদি। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনায় অবস্থিত কেরু এ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (১৯৩৩) বাংলাদেশের বৃহত্তম চিনি কল। কেরু এন্ড কোম্পানির সাথে যে ডিস্টালারিটি আছে তা বাংলাদেশের একমাত্র মদ্য প্রস্তুতকারী কারখানা। কেরু এন্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের (Bangladesh Sugar and Food Industries; BSFIC) অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান; যা বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান।
প্রধান রপ্তানী পণ্যগুলো হল পান, ভুট্টা, শাক-সবজি, ধান, চাল, পাট, বিস্কুট, চিনি, তামাক, আখ, খেজুরের গুড়, সুপাড়ি, আম, কুমড়া, কাঁঠাল, কলা, ফিড, এস.এস.আসবাবপত্র,হাঁস-মুরগীর বাচ্চা, ঔষধ এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী ইত্যাদি।
নদ–নদী
চুয়াডাঙ্গা জেলার মধ্য দিয়ে ৫ টি নদ-নদী প্রবাহিত-
- মাথাভাঙ্গা
- ভৈরব
- কুমার
- নবগঙ্গা
- চিত্রা
পুরাকীর্তির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
ঠাকুরপুর মসজিদঃ
চুয়াডাঙ্গা উপজেলার ঠাকুরপুর গ্রামে একটি পুরোনো মসজিদ আছে। ১৬৯৮ সালে শাহ্ আর মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন চিশ্তী ওরফে শাহ্ আফু পশ্চিম থেকে নবগদা পেরিয়ে এসে ঠাকুরপুর গ্রামে আস্তানা গাড়েন। তিনি একজন নির্জন সাধক ছিলেন। সবসময় ধ্যানমগ্ন থাকতেন, নামাজের সময় হলে কদাচ তিনি বাইরে আসতেন।
জামজামি মসজিদঃ
আলমডাঙ্গা উপজেলার জামজামি গ্রামের কাজী গোলাম বাংলা ১৩০৭ সালে কুষ্টিয়ার ঝাউদিয়া শাহী মসজিদের অনুরুপ একটি বর্গাকার মসজিদ তৈরি করেন। মসজিদটি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে ৩৬ ফুট। তিনি গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদের বারান্দার দেয়ালে সুন্দর নক্শা আঁকা আছে।
তিওরবিলা মসজিদঃ
নবাব আলীবর্দ্দী খানের আমলে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তিওরবিলা গ্রামে একটি মসজিদ নির্মিত হয়। বাংলা ১১৬৮ সালের ৯ কার্তিক তারিখে একখন্ড সদনমূলে রানী ভবানী এই মসজিদ তৈরি ব্যবস্থাপনা ও তদারকির জন্যে২৫ একর ৩৫ শতক জমি ওয়াক্ফ করে দেন। জনৈক বক্তার চৌধুরীকে মুতাওয়াল্লী নিযুক্ত করা হয়। পরে এই সম্পত্তি ইংরেজি ১৯৪১ সালে বৃটিশ সরকারের ৮০২৭ নং ওয়াক্ফ এস্টেট হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু মসজিদের সম্পত্তি আত্নসাত করা হয়। আদি কাগজপত্রেরও কোন হদিস নেই। অপরদিকে তদারকি ও সংস্কারের অভাবে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়লে সেখানে নতুন মসজিদ নির্মিত হয়।
শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণ মন্দিরঃ
১৯১৭ সালে চুয়াডাঙ্গার ফেরিঘাট রোডে বৈদ্যনাথ আগরওয়ালা, মোহনলাল আগরওয়ালা ও শনি নারয়ণ আগরওয়ালার উদ্যোগে শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। উল্লেখিত তিনজন ভারতের রাজস্থান থেকে এখানে এসে ব্যবসা শুরু করেন এবং প্রতিপত্তি অর্জন করে বণিকদের উপাস্য দেবতা শ্রী সত্যনারায়ণের নামে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
গীর্জাঃ
খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৫টি গীর্জা ও কয়েকটি মিশনারি আছে। এগুলো হচ্ছে কার্পাসডাঙ্গার চার্চ অব বাংলাদেশ ও রোমান ক্যাথলিক চার্চ, খেজুরায় চার্চ অব বাংলাদেশ, ডিঙ্গেদহে এস.ডি.এ (Sevent IB day advantage) এবংবাঘাডাঙ্গায় রোমান ক্যাথলিক চার্চ।
চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনীয় স্থান ও স্থপনা
- পুলিশ পার্ক- পুলিশ সুপার-এর কার্যালয় সংলগ্ন.
- শিশু স্বর্গ- ফেরি ঘাট রোড.
- নাটুদহের আট কবর- মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আটজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর.
- কেরু এন্ড কোম্পানি এন্ড ডিস্টিলারি- দর্শনা.
- তিন গম্বুজবিশিষ্টচুয়াডাঙ্গা বড় মসজিদ.
- ঘোলদাড়ি জামে মসজিদ(১০০৬ খ্রিষ্টাব্দ) – আলমডাঙ্গা উপজেলার ঘোলদাড়ি গ্রামে.
- তিয়রবিলা বাদশাহী মসজিদ- আলমডাঙ্গা উপজেলার খাসকররা ইউনিয়নের তিয়রবিলা গ্রাম.
- ঠাকুরপুর মসজিদ.
- শিবনগর মসজিদ.
- জামজামি মসজিদ.
- আট কবর- দামুড়হুদা.
- হাজারদুয়ারি স্কুল- দামুড়হুদা.
- নীলকুঠি- কার্পাসডাঙ্গা ও ঘোলদাড়ি.
- আলমডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন- ব্রিটিশ আমলে নীলকুঠি হিসেবে ব্যবহৃত হত.
- খাজা মালিক উল গাউস-এর মাজার – তিতুদহ ইউনিয়নের গড়াইটুপি গ্রাম ।
- রাখাল শাহ এর মাজার।
- কাশিপুর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতি বিজড়িত জমিদার বাড়ি।
- গণকবর ধোপাখালী ।মনোহরপুর ইউনিয়ন
- কুমারী সাহা জমিদার বাড়ি
- পাঁচ কবর- হৈবতপুর-মদনা(মুক্তিযুদ্ধে ৫ জন শহীদ হন)।
চুয়াডাঙ্গা জেলার কৃতি ব্যক্তিত্ব
- হারুনুর রশীদ (বীর প্রতীক)- খেতাবপ্রাপ্ত শহীদ বীরপ্রতীক।
- খোদা বক্স সাঁই- (গীতিকার সুরকার ও গায়ক – ১৯৯১ সালে একুশে পদকপ্রাপ্ত
- অনন্তহরি মিত্র(১৯০৬ – ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯২৬) – ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের শহীদ বিপ্লবী।
- বেবী ইসলাম- প্রখ্যাত আলোকচিত্রী, চিত্রগ্রাহক ও চলচ্চিত্র পরিচালক (তিনবারশ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহকের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন)।
বিঃদ্রঃ এখানে দেওয়া সকল তথ্য ইন্টারনেট এর বিভিন্ন তথ্যমূলক ওয়েবসাইট ও স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দেওয়া হয়েছে। যদি কোনো তথ্যে ভুল থাকে তাহলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং সঠিক তথ্য দিয়ে ভুল টা সংশোধন করার জন্য আমাদের সাহায্য করবেন এবং এই তথ্য টি পরে যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে তথ্যটি শেয়ার করবেন ।